বিদ্রোহ-পরবর্তী রাশিয়ায় প্রত্যাশা নিয়ে পশ্চিমাদের অসতর্কতার বিপদ!
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের নির্দেশে ইউক্রেনে ২০১৪ সালে সংঘটিত হয় ইউরো মেইডান ক্যু। রুশপন্থী সরকার উৎখাত হয়ে ক্ষমতায় আসে পশ্চিমাপন্থীরা। ন্যুলান্ড বাইডেন প্রশাসনেও আছেন। বর্তমানে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি। ২০১৪ সাল থেকেই আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিশ্বায়নবাদী অংশের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ায় শাসকগোষ্ঠীর বদল।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এরপর ২৬ মার্চ শাসক বদলের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, (পুতিন) 'আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না'।
এরপর চলতি সপ্তাহে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ওয়াগনার গ্রুপ। এতে রুশ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হলে, তার কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মতামত বিশ্লেষণের জোয়ার দেখা যায়। সামাজিক গণমাধ্যমেও চলে জোর আলোচনা। যদিও দিনশেষে বেলারুশের প্রসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর দেওয়া প্রস্তাব মেনে নেন ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। তার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনীকে নির্দেশ দেন মস্কো অভিমুখে যাত্রা থামানোর। ফলে পুতিনের প্রতি চ্যালেঞ্জ দূর হয়। তিনি এখনো বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় রয়েছেন।
এই বিদ্রোহের ঘটনায় রাশিয়ার কট্টর-জাতীয়তাবাদীদের পায়ের নিচে মাটি আরও শক্ত হয়েছে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগসহ অন্যান্য কৌশলগত ঝুঁকি অনেকটাই বেড়েছে।
ইউরো মেইডানকে পুতিনকে উৎখাতের সূচনালগ্ন হিসেবে মনে করেছিলেন ন্যুল্যান্ড ও তার সহকর্মীরা। কিন্তু, এই ঘটনার পর থেকে মন্দ ধাঁচের এক জাতীয়তাবাদের দিকেই এগোতে থাকে রাশিয়া। কারণ, আমেরিকা-সমর্থিত এই ক্যুতে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ অপসারিত হলে, ক্রিমিয়ায় রুশ নৌঘাঁটির ইজারা নবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনীর উপস্থিতিও পড়ে হুমকির মুখে। ফলে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে বাধ্য হয় রাশিয়া — সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের সময় থেকেই যে ভূখণ্ড রাশিয়ার অংশ ছিল। ফলে এই সিদ্ধান্তের ঐতিহাসিক আবেদনও আছে রুশ জাতীয়তাবাদের কাছে।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীগুলোর অনেক সদস্যসহ নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশ মনে করছে, পশ্চিমাদের রুশবিরোধী নীলনকশা মোকাবিলায় দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছেন পুতিন। প্রিগোজিনের বিদ্রোহও ছিল এই মতবাদের প্রতিফলন। পুতিনের ঘনিষ্ঠ এবং চেচেন ওয়ারলর্ড রমজান কাদিরভও তা বিশ্বাস করেন। অথচ ওয়াগনার বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখে দিয়ে মস্কোকে রক্ষায় কাদিরভের সেনা পাঠানোর ওপর নির্ভর করেছিলেন পুতিন। বিদ্রোহের আগপর্যন্ত সামরিক বাহিনীর ওপর পুতিনের নিয়ন্ত্রণের বিরোধী ছিলেন কাদিরভ ও প্রিগোজিন। দুজনেই বিভিন্ন সময় ইউক্রেনে আরও আগ্রাসী ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
বিস্ময়কর হলো গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পুতিনের অজান্তেই ওয়াগনার যোদ্ধাদের নিয়ে মস্কো আসতে সামরিক পরিবহনের ব্যবস্থা করেছিলেন প্রিগোজিন। এ বিষয়ে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওয়াকিবহাল ছিল বলে কিছু গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে।
আরও বিস্ময়কর হলো, রস্তভ থেকে মস্কো অভিমুখে ওয়াগনার অগ্রসর হওয়ার সময় কোনো রুশ বাহিনী তাদের বাধা দেয়নি। ফলে রাজধানীর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ে এই কনভয়। যদিও কয়েকটি হেলিকপ্টার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, এরমধ্যে তিনটিকে ভূপাতিত করে ওয়াগনার বাহিনী।
পরিস্থিতি যখন এত নাজুক, তখন রাজধানী রক্ষায় প্রিগোজিনের মিত্র কাদিরভের শরণাপন্ন হতে হয় পুতিনকে। এটাই সবচেয়ে বিস্ময়কর। এরপর বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে পুতিন এক সমঝোতার প্রস্তাব পাঠান। এর আওতায়, বিদ্রোহীদের সকল অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়। পুরো ঘটনার সময় রুশ সামরিক বাহিনীর ভূমিকা যৎসামান্য ছিল বলা যায়। এতে প্রমাণ হয়, তারা নিস্ক্রিয় থেকে পুতিনকে একটি সতর্কবার্তা দিয়েছে প্রিগোজিনের মাধ্যমে।
মস্কোতে বইছে উগ্র-জাতীয়তাবাদী 'গ্রেট রাশিয়া' চেতনার জোয়ার। এর অনুসারীরা মনে করছেন, পুতিন পশ্চিমাদের বিষয়ে নমনীয়। কারণ, ২০০০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাছে ন্যাটোতে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করেছিলেন পুতিন, যা প্রত্যাখ্যান করেন ক্লিনটন। ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছিলেন ওয়াশিংটনের কাছ থেকে, কিন্তু ২০০৪ সালের অরেঞ্জ বিপ্লবে সহায়তা দিয়ে সে প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করে ক্ষমতাসীন বুশ প্রশাসন।
তখন মিনস্ক-২ সমঝোতার আওতায়, ইউক্রেনের রুশভাষী সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে একটি চুক্তিও করেন তিনি। ২০২২ সালে ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থনে যে চুক্তি মানতে অস্বীকার করেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি।
এমন প্রেক্ষাপটে, পুতিন রাশিয়ার চরম ডানপন্থীদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পর। যদি তাকে উৎখাত করা হয়, তাহলে যিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তিনি হতে পারেন আরও কট্টর। মোটেও তেমন উদার গণতান্ত্রিক নেতা হবেন না তিনি, যে স্বপ্নে বিভোর ওয়াশিংটন। বরং কট্টর রুশ জাতীয়তাবাদী এমন কেউ হবেন, যিনি প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করে হলেও ইউক্রেনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকেই ধ্যানজ্ঞান করবেন।
বর্তমানে রাশিয়ায় উদারনৈতিক রাজনীতির উল্লেখযোগ্য কোনো জোয়ার নেই। অথচ রাশিয়ান অভিজাতরা অতি-জাতীয়তাবাদীদের শক্তিশালী একটি গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছেন, যারা 'গ্রেট রাশিয়া' স্লোগানের অন্তরালে রুশ সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায় ফিরিয়ে আনতে চায়। আশঙ্কার কথা হলো, বিভিন্ন বিষয়ে অমিল থাকা বেশকিছু গোষ্ঠীর থেকে এই চেতনা আরও ছড়িয়ে পড়ছে।
এর মধ্যে আছেন, লিবারেল-ডেমোক্রেটিক দলের নেতা লিওনিদ স্লাতস্কি; দার্শনিক আলেক্সান্ডার দুগিন; জনপ্রিয় টেলিভিশন শো উপস্থাপক ভ্লাদিমির সোলোভায়েভ ও দিমিত্রি দিবরভ; চেচেন নেতা কাদিরভ এবং মস্কোর প্যাট্রিয়াক (ধর্মীয় নেতা)-এর টেলিভিশন চ্যানেল এসপিএএস; এবং নিউ জারিস্ট ইউনিয়ন অব দ্য রাশিয়ান পিপল।
এর আগে প্রিগোজিনের পরামর্শে রাশিয়ার যেসব শীর্ষ কিছু সামরিক কর্মকর্তাকে জোর করে অবসরে পাঠিয়েছিলেন পুতিন, তারাও এখন পুতিনের ওপর যথেষ্ট ক্ষুদ্ধ। প্রেসিডেন্টের সামরিক শিথিলতা নিয়ে তারা অসন্তুষ্ট; একইসঙ্গে, পুতিনের নির্বাচিত কমান্ডারদের দুর্বল পারফরম্যান্স তাদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এক কথায়, অতি-জাতীয়তাবাদী শিবিরে আছে নানান বিভাজন। তারপরও ইউক্রেনে যেকোনো মূল্যে জয়ের বিষয়ে তারা একমত। তাদের আরও বিশ্বাস, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্ত জয়ের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।
অর্থাৎ, তারা পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো বর্তমানে ন্যাটো সদস্য, তাদের ওপর হামলা করতেও আগ্রহী। আর যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী ২,০০০ ট্যাক্টিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র আছে মস্কোর। ফলে এসব অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি শুধু আর গণমাধ্যমের জল্পনা-কল্পনায় সীমাবদ্ধ নয়। ইতোমধ্যেই, 'গ্রেট রাশিয়া' জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে অগ্রণী মুখপাত্র এসব অস্ত্র মোতায়েনের দাবি তুলেছেন।
গোষ্ঠী আলাদা আলাদা হলেও এই জাতীয়তাবাদীদের মাথা এক — আলেক্সান্ডার দুগিন। ২০২৩ সালের মার্চে এক টেলিগ্রাম পোস্টে তিনি সমস্ত রাশিয়ান সেনাশক্তি সমাবেশ, অর্থনীতির সামরিকীকরণ, যুদ্ধ-বিরোধীদের গ্রেপ্তার এবং এসব পদক্ষেপ সফল না হলে প্রয়োজনে ট্যাক্টিক্যাল নিউক ব্যবহারের দাবি জানান।
বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে ন্যাটোর যুদ্ধ। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দ্বারা প্রশিক্ষিত, বেতনভাতাপ্রাপ্ত ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। রাশিয়ার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ জব্ধ করাসহ পশ্চিমাদের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল। রাশিয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতেই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু, পশ্চিমাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাশিয়ার কট্টর জাতীয়তাবাদীদের বলীয়ান করছে। তাদের নৈতিক শক্তি জোগাচ্ছে। তাছাড়া, রাশিয়ার সব মতের মানুষই বিশ্বাস করে, পশ্চিমাদের মূল লক্ষ্য বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন, এবং জাতিগত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ভৌগলিকভাবে সুদূর বিস্তৃত রাশিয়ান ফেডারেশনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলা।
পশ্চিমাদের এসব লক্ষ্য নিয়ে উদ্বেগে অস্থির নয় রাশিয়ানরা। বাইডেন প্রশাসনে থাকা অনেক কর্মকর্তারই এই এজেন্ডা এক দশকের বেশি সময় ধরে রয়েছে।
কিন্তু, পুতিনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের মতো শক্তিশালী উদার-গণতান্ত্রিক দল নেই রাশিয়ায়। আছে কেবল কট্টর জাতীয়তাবাদীরা। ক্ষমতায় গেলে আরও ভয়াবহ পরিণতিই ডেকে আনবে তারা। যার মাশুল পুরো বিশ্ববাসীর পাশাপাশি পশ্চিমাদেরও দিতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।