ইউক্রেনের সাথে শস্যচুক্তি থেকে কেন সরে দাঁড়াল রাশিয়া
বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রেখে - দুর্ভিক্ষ, অনাহারের ঝুঁকিকে সীমিত রাখার উদ্যোগ রাশিয়া-ইউক্রেন 'কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি' অকার্যকর হয়ে গেছে। প্রায় এক বছর ধরে কার্যকর থাকা এই চুক্তি থেকে গত ১৭ জুলাই সরে আসার ঘোষণা দেয় রাশিয়া।
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দরগুলোয় জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। কৃষ্ণসাগর ঘিরে কার্যত নৌ-অবরোধ কায়েম করে রুশ যুদ্ধজাহাজ। এরমধ্যেই বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্ততায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্যচুক্তিটি সম্পাদিত হয়।
এর আওতায়, অবরোধ পাশ কাটিয়ে ইউক্রেন থেকে শস্যবাহী জাহাজ কৃষ্ণসাগরে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু, রাশিয়া কেবল চুক্তিটি থেকে সরেই আসেনি, বরং পরের দুই দিনে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির অন্যতম বন্দর ওডেসায় বোমা হামলা চালিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। এতে ৬০ হাজার টনের বেশি শস্য ধবংস হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ঘটনায় বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য বেড়ে যায়। এরমধ্যেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য বাজারে গম, ভূট্টা ও সয়াবিনের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন গম, বার্লি, ভুট্টা, রাই শর্ষে ও রাই শর্ষের তেল, সূর্যমুখী ফুল ও সূর্যমুখী ফুলের তেলের প্রধান দুটি উৎপাদক দেশ। এ ছাড়া নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস সারেরও প্রধান উৎপাদক।
এই বাস্তবতায় কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি কি, এবং কেন এটি বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ – তা জেনে নেওয়া দরকার।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, খাদ্যসহ সরবরাহ শৃঙ্খল বিশেষজ্ঞ এবং কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্সের পরিচালনা পর্ষদের কো-চেয়ার অধ্যাপক আন্না নগুর্নে। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধের সূত্রে ব্যাখ্যাটি টিবিএসের পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো।
বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেন ইউক্রেন?
ইউরোপের 'রুটির ঝুড়ি' বলে পরিচিত ইউক্রেন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, চীন-সহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে গম, যব, বার্লি, ভুট্টা, সূর্যমুখী ফুলের তেলের একটি প্রধান সরবরাহকারী।
২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণের আগে ইউক্রেনীয় খাদ্যপণ্য সরবরাহের ওপর নির্ভর করতো বিশ্বের ৪০ কোটির বেশি মানুষ।
এর অন্যতম কারণ মাটির উর্বরতা। বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর মাটি হলো কালো মাটি, যা চেরনোজেম নামেও পরিচিত। আর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ কালো মাটির জমি রয়েছে ইউক্রেনে। যুদ্ধের আগে পুরো বছরজুড়ে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো দিয়ে নিকটবর্তী অঞ্চল– আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শস্য রপ্তানি করতো দেশটি।
যুদ্ধ শুরুর পর যা হয়
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুর্ভিক্ষের সূচনা হয়েছিল। দিন দিন যা আরও তীব্র হচ্ছিল। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, করোনা মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাত ও ইউক্রেন যুদ্ধের মিলিত প্রভাবে ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছে বলে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অন্যান্য গবেষকরা বলছেন, গত দুই দশকের মধ্যে বর্তমান সময়েই সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বৈশ্বিক ক্ষুধা ।
২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটি টন শস্য ইউক্রেনের বন্দরগুলোয় জমা হয়। এসব শস্য বিশ্ববাজারে রপ্তানির উদ্দেশ্য থাকলেও, রাশিয়ার অবরোধের কারণে তা করা যায়নি। এতে বিশ্ববাজারে চড়া হয় খাদ্যের দাম।
কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি যেভাবে বাস্তবায়িত হয়, এবং তার সুফল
২০২২ সালের ২২ জুলাই ইস্তাম্বুলে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উপস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্যচুক্তিটি সম্পাদিত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ইউক্রেন তার সর্ববৃহৎ বন্দর ওডেসা-সহ আর ৩ বন্দর দিয়ে নিরাপদে কৃষিপণ্য রপ্তানির সুযোগ পায়। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি ১২০ মেয়াদে কার্যকর হলেও, পরে আরও বেশ কয়েকবার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
সেই সুবাদে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ৩ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে কিয়েভ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সহায়তা সংস্থা –জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি – তাদের ৮০ শতাংশ গম কিনেছে ইউক্রেন থেকে। মানবিক এসব সহায়তার বড় অংশ পেয়েছে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও তুরস্ক।
জাতিসংঘের হিসাবমতে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে বৃদ্ধি পাওয়া খাদ্যের দাম ২৩ শতাংশ কমাতে অবদান রেখেছে কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তিটি।
কিন্তু, চলতি বছরের জুলাইয়ে চুক্তিটি অকার্যকর হওয়ার আগে থেকেই শস্যের চালান রপ্তানির পরিমাণ কমতে শুরু করেছিল। যেমন গত বছরের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৪২ লাখ টন শস্য রপ্তানি হলেও, এবছরে জুনে তা নেমে আসে প্রায় ২০ লাখ টনে।
জাহাজে করে ইউক্রেনে অস্ত্র বা যুদ্ধ-সরঞ্জাম আমদানি করা হচ্ছে কিনা - তা পরীক্ষার জন্য চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেনের বন্দরগামী জাহাজগুলো পরীক্ষা করতো রাশিয়া, তুরস্ক ও জাতিসংঘের পরিদর্শকরা। কিন্তু, রুশ পরিদর্শকদের তৎপরতা কমায় রপ্তানি চালানও ব্যাহত হয়।
তাছাড়া, ইউক্রেনে শস্য উৎপাদনও কমছে। চলতি মওসুমে ইউক্রেনে যুদ্ধ-পূর্ব একই সময়ের তুলনায় গমের উৎপাদন ৩১ শতাংশ কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে এই হিসাব, গত ৬ জুন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি বাঁধ হওয়ার আগের। এতে করে কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হবে বলে জানায় কিয়েভ।
ইউক্রেনের রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগর এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
চলতি বছরের মে মাসে ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্সের সহকর্মীদের সাথে করা আমার একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিশ্বের কাছে ইউক্রেনের শস্যের চালান পৌঁছাতে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমরা তুলে ধরি।
যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ কৃষিপণ্য রপ্তানি-ই হতো কৃষ্ণসাগর দিয়ে। ইউক্রেন স্থলপথে ইউরোপে শস্য ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য রপ্তানি করলেও – তাতে খরচ অনেক বেশি সময় এবং সমুদ্র বন্দর দিয়ে রপ্তানির চেয়ে সময়ও বেশি লাগে।
তাছাড়া, যুদ্ধের কারণে ভূমি মাইনের হুমকি ও কৃষি রপ্তানির অন্যান্য অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণে পরিবহন খরচও বাড়ছে।
চুক্তি থেকে কেন সরে গেল রাশিয়া?
এর আগেও বেশ কয়েকবার চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল মস্কো, তবে প্রতিবারই চুক্তিটি কার্যকর রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু, গত ১৭ জুলাই দেশটি স্পষ্টভাবে জানায়, তাদের আরও বেশি পরিমাণ খাদ্য ও সার রপ্তানির দাবি মেনে না নিলে তারা চুক্তি থেকে সরে যাবে। এরপরের দুইদিনে ওডেসা বন্দরে ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে হামলা করেছে। এপর্যন্ত বন্দরটির ওপর অন্যতম বড় পরিসরের ছিল এই হামলার ঘটনা।
রাশিয়া আরও জানিয়েছে, কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের বন্দরগামী যেকোনো জাহাজকে তারা সামরিক আক্রমণের বৈধ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করবে।
এতে বিশ্ববাজারে গম ও ভূট্টার দাম আবারো বাড়তে শুরু করে। বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাও এতে করে গভীর অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। রাশিয়া চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর থেকে – গমের অন্যতম বৈশ্বিক মূল্যসূচক শিকাগো ফিউচার্সের ১৭ শতাংশ উল্লম্ফন ঘটেছে।
এর আগে রাশিয়া চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি না করার হুমকি দিলেও, এবারের কথা ভিন্ন। রাশিয়ার হামলায় এরমধ্যেই মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে ওডেসা বন্দরের, এতে ভবিষ্যতে চুক্তি কার্যকর হলেও ইউক্রেনের রপ্তানি সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।
আমার বিশ্বাস, বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নিচ্ছেন পুতিন। খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। তবুও আশা, উভয়পক্ষের সদিচ্ছাই শেষপর্যন্ত জয়ী হোক, এবং ইউক্রেনকে শস্য রপ্তানির সুযোগটি অব্যাহত রাখা হোক।
- লেখক: আন্না নগুর্নে ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টেগ্রেটিভ স্টাডিজের ইউজিন এম আইজেনহাওয়ার চেয়ারপার্সন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।