বাখমুতের মতো লড়াইয়ের মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি বা বিস্তৃতি ঘটতে পারে
যুক্তরাষ্ট্র যে দাবিই করুক না কেন, রাশিয়ার ভূখণ্ডে আরো হামলা হওয়ার আশঙ্কা করছে রুশ সরকার। বিশেষত রাশিয়ার রাজধানী মস্কোসহ বন্দরগুলোয় এই ধরনের হামলা বাড়বে – পুতিনের সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর- পেন্টাগন বলছে, মার্কিন সমরাস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলায় ব্যবহার করা হবে না, যা আসলে নির্জলা মিথ্যা। বরং ওয়াশিংটনের সরবরাহ করা ড্রোন, হিমার্স মিসাইল, ক্লাস্টার গোলা নিয়মিতভাবে রুশ ভূখণ্ডে হামলায় ব্যবহার করছে ইউক্রেন।
একইভাবে ব্যবহার হচ্ছে ইউরোপে তৈরি স্ক্যাল্প-ইজি মিসাইল। লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রটি নির্মাণ করেছে ফরাসী, ব্রিটিশ ও ইতালীয় কোম্পানিগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম- এমবিডিএ।
পশ্চিমা জোট বলে আসছে, ইউক্রেনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই রুশ বাহিনীকে পরাজিত করার অস্ত্র দেবে, কিন্তু রাশিয়ায় আঘাত হানার মতো সহায়তা দেবে না, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বলছে অন্যকথাই। শুধু অস্ত্র নয় – তাদের গ্লোবাল হক নজরদারি ড্রোন কেন রুশ ভূখণ্ডের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে – তারও কোনো ন্যায্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ওয়াশিংটন। সহজেই অনুমান যায়, রাশিয়ার সামরিক-বেসামরিক উভয় ধরনের স্থাপনা, সম্পদের ওপর হামলা চালাতে সহায়ক তথ্য দিচ্ছে গ্লোবাল হক।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে, ক্রিমিয়ার সাথে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডকে যুক্ত করা কের্চ সেতুতে হামলা চালাতে ইউক্রেনকে সেমি- সাবমার্সিবল কামিকাজে ড্রোন দিয়েছে, এমনকী এর নীলনকশা তাদেরই- যা ছিল সরাসরি রাশিয়ার ওপর আক্রমণ।
মস্কোর নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের অভিযানের ঘটনা স্মরণে রেখেছেন; এ যুদ্ধকে তারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে মনে করছেন।
তাই সার্বিকভাবে পেন্টাগন বা হোয়াইট হাউস যাই বলুক – বাইডেন প্রশাসন আসলে ইউরোপে যুদ্ধকে ছড়িয়ে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
যেমনটা দেখা যাচ্ছে, এ যুদ্ধে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য যদি তাই-ই হয় – তাহলে আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান শুধু অধরাই নয়, বরং আরো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
গত ৫ আগস্ট ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তথাকথিত শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে সৌদি আরব। এতে ইরানসহ অন্তত ৩০টি দেশ অংশ নেয়। কিন্তু, রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ফলে এ আয়োজনটি যে নেহাত প্রোপাগান্ডা, এবং প্রকৃতঅর্থে গুরুতর কোনো চেষ্টা নয় – তাও প্রমাণ হয়েছে।
এই অবস্থায়, আজ হোক বা কাল – ইউক্রেন যুদ্ধ নিস্ফল মনে করে রণেভঙ্গ দিতে পারে রাশিয়া। অথবা, কিয়েভের পশ্চিমা সমর্থকদের বিরুদ্ধে (সামরিক) ব্যবস্থা নিতে পারে।
রাশিয়া রণেভঙ্গ দিলে, মস্কোয় সরকার পতন ঘটতে পারে। আর যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে, রাশিয়ার কট্টর জাতীয়তাবাদীদের জন্য তা হবে বড় বিজয়, তখন তারা যুদ্ধ বিস্তারের দাবি জানাবে। সে পর্যায়ে, পুতিনকে হয় তার সরকারে বড় পরিবর্তন আনতে হবে, অথবা ২০২৪ সালের নির্বাচনে আর না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পুতিন সরে দাঁড়ালে- তার জায়গা নিতে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পদস্থ কিছু কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। তাদের মধ্য থেকে, কট্টর জাতীয়তাবাদী শিবিরের কোনো প্রার্থীই বিজয়ী হবেন এমন সম্ভাবনাই বেশি।
প্রতিকূলতার মুখেও রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কতখানি অদম্য তা কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না। ইউক্রেনে উভয় পক্ষই ডনবাস ও দক্ষিণের ঝাপোরিঝিয়া এলাকায় অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত। এদিকে ইউক্রেন বিপুল যুদ্ধসরঞ্জাম ও সেনা হারিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু দাবি করেছেন, গত জুলাই মাসে ইউক্রেনের ২০ হাজার সেনা নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা নির্ণয় করাটা বেশ কঠিন। রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে গেলে – জনবলের ঘাটতি থাকা ইউক্রেনের রিক্ত, নিঃস্ব হতে আর কতদিন লাগবে- সেটাই এখন প্রশ্ন।
রণাঙ্গনের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে মনে হবে, ইউক্রেনকে সরাসরি সাহায্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তারা আশা করছে, দক্ষিণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে পারবে ইউক্রেনীয় সেনারা। একইসঙ্গে, এই আক্রমণের সময় বাখমুতের কাছাকাছি পার্শ্বদেশ রক্ষা করতে পারবে। অভিযান সফল হলে, বাখমুতের পুনর্দখল নিতে পারবে।
কিন্তু, এই পরিকল্পনায় বড় সমস্যা হলো – দক্ষিণে ঝাপোরিঝিয়ায় যদিওবা ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়, তারপর পাশে বা পেছন থেকে (ডনবাস) তাদের ওপর হামলার ঝুঁকি রয়েই যায়।
গত সপ্তাহে বাখমুতের কাছাকাছি চাসিভ ইয়ার এলাকায় যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখতে যান জেলেনস্কি। রুশ সেনাদের বাখমুত দখলের পর প্রথম তিনি ওই এলাকায় গেলেন। এতে প্রমাণ হয়, পার্শ্বভাগ অরক্ষিত রেখে ঝাপোরিঝিয়ায় অভিযানের বিপদ গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে কিয়েভ। অর্থাৎ, বাখমুতের দিকটা নিরাপদ করাটা আবারো দরকারি হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে, আরো একবার বাখমুত ঘিরে বইবে রক্তবন্যা।
জেলেনস্কি আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তা এবং তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত ব্রিগেডগুলো দিয়ে তিনি এবারের লড়াইয়ে জিততে পারবেন।
তাই এবার বাখমুতে যা ঘটবে – তা হয়তো রাশিয়া বা ইউক্রেন যে কোনো একপক্ষের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের অন্ত সূচনা করবে।
রাশিয়া জিতলে, তাদের শর্তানুযায়ী শান্তিচুক্তি করতে হবে ইউক্রেন সরকারকে। আর ইউক্রেন জিতলে, দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর দখল ধরে রাখতে– রাশিয়াকে পূর্ব ইউক্রেন থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে, রাশিয়ার কাছে বিপজ্জনক আরেকটি উপায় আছে। ইউক্রেনের সীমানার বাইরে পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোয় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে ক্রেমলিন। পুতিন যদিও বলেছেন, তিনি যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিতে চান না, কিন্তু তার প্রশাসনের ওপর কট্টর জাতীয়তাবাদীদের চাপ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, অভ্যন্তরীণ যেকোনো অস্থিতিশীলতা রাশিয়াকে আরো আক্রমণাত্মক করে তুলবে।
গত ৩০ জুলাই, সেন্ট পিটার্সবার্গে নৌবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান উদযাপন করে রাশিয়া। ঐতিহ্যবাহী এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পুতিন কিন্তু তার বক্তব্যে ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো উল্লেখ করেননি। এটা কি তার অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে অনড় থাকার প্রতীক?
সময়ই এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট, এই যুদ্ধের ভাগ্য খুব বেশিদিন অনির্ধারিত রাখা যাবে না। রাশিয়ায় শাসকগোষ্ঠী বদলের জুয়া খেলছে ন্যাটো। কিন্তু, প্রত্যাশার বিপরীত ফল আসতে পারে এতে। আসলে, রাশিয়ায় শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন ন্যাটোর জন্য বিষময় হয়ে উঠবে।
পাশার অপরদিকে, ইউক্রেনে জয়ের জন্য বাজি ধরেছে রাশিয়া। তবে কঠিন এ লড়াই অনেক দীর্ঘসময় নিয়ে চলছে। এরমধ্যে চূড়ান্ত কিছু লড়াইয়ে জিতে রুশ সেনাদের তাড়াতে চাইছে ইউক্রেন। পরিস্থিতি যেকোনো দিকেই মোড় নিতে পারে। কারণ পাশার দানে এখনও বাজি ধরার সুযোগ আছে।