সন্ধিক্ষণে ভারতের গণতন্ত্র!
জমে উঠেছে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। যেমনটি প্রতিবার হয়। ভারতের নির্বাচন সবসময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকে। এবারের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ১৯ এপ্রিল শুরু হয়ে সাত দফায় ১ জুন ভোট গ্রহণ শেষ হবে। এরপর গণনা। ফল জানা যাবে ৩ জুন।
গত ১৬ মার্চ দিল্লিতে ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল ঘোষণার সাথে সাথেই নির্বাচনী আচরণবিধি ও নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। সেই হিসেবে নির্বাচনের ব্যাপ্তি ৮২ দিন।
ভারতের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা সাথে সাথে প্রশাসন ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যেই তারা বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ আধিকারিকদের পরিবর্তন করেছেন। পরিবর্তন করেছেন প্রশাসনের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে। ভারতের নির্বাচন কমিশন যথার্থই তাদের সক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত থাকেন। যদিও ইতিহাসের পাতায় নানান ঘটনা আছে তাদের নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আছেন তিন জন। তফসিল ঘোষণার আগের দিনই এদের মধ্যে দুজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনোনীত করা হয়।
ভারতে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাধারণত প্রাক্তন আমলাদেরকেই বেছে নেওয়া হয়। বিশাল এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কমিশনকে আমলাতন্ত্রের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয়। এই আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও কমিশনের নির্দেশনা অনুসরণ ও মান্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনাররা (যারা একসময় আমলাতন্ত্রের অংশ ছিল) বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু ভারতে নির্বাচন কমিশনের বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। যেমন, এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট-ইডি, আয়কর বিভাগ, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- সিবিআই।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন রাজ্যে আয়কর বিভাগ এমনকি সিবিআই বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এই সপ্তাহেই পয়লা বৈশাখের দিন আয়কর বিভাগ তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টারে তল্লাশি চালায়। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে সেই তল্লাশি চালানোর পরে তাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যে তারা (আয়কর বিভাগ) কোনো কিছুই পায়নি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে এই পদক্ষেপগুলো কেবল বিরোধী দলের নেতাদের ক্ষেত্রেই চলছে। সেই কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধেই কেবল এই ডিপার্টমেন্টগুলোর অভিযান কেন?
ভারতে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক দলকে আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যে নির্বাচনী বন্ড কিনতে পারবে। ২০১৯ সালে এরকম একটি আইন পাস হয়। তখনই এ বিষয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভারতের অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, এই নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইনটি বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার সাথে সাথে বন্ডে টাকা প্রদানকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে আবগারি দুর্নীতির মামলায় দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল কারাগারে আছেন। ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কেজরিওয়ালকে কারাগারে নিয়ে গেলেন, তা কিন্তু নির্বাচনের পরেও এই তদন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারত। অনুসন্ধানের ফলাফল পরবর্তীতে তার বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কিন্তু নির্বাচনের আগে এই পদক্ষেপগুলো ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
ভারত বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। কখনো পশ্চিমাদের সঙ্গে কখনো রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক কৌশলের সাফল্য দেশটিকে শক্তিশালী করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সময়ে ভারতের গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে। ভারতে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ তীব্র। যেমন মহারাষ্ট্র কিংবা দক্ষিণের রাজ্যগুলো, বাংলা, আসাম– এরা সবাই তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীতে যতগুলো ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এমনকি জাপান– তারাও একক ভাষায় জনগণ পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কিত। যদিও ভারতের প্রধান কেন্দ্রীয় ভাষা ইংরেজি সাথে হিন্দিও চলমান। তথাপি আঞ্চলিক ভাষাগুলোর গভীর অবস্থান ভারতকে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করছে। এর সঙ্গে আছে ধর্ম। ধর্মীয় বিভাজনও ভারতীয় সমাজের একটি গভীর ক্ষত। এসব কিছু বিবেচনা করেও ভারতের ফেডারেল কাঠামোতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে নির্বাচন ব্যবস্থাটা অত্যন্ত গভীর ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বল দিক হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী দলের নেতাদের এইভাবে নানান তদন্ত মামলায় অভিযুক্ত করা। এই সময় বিজেপির কিংবা বিজেপির মোর্চার কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে কোথাও তেমন কোনো বড় অভিযোগও আসছে না। কিংবা প্রকাশ্যে এই সমস্ত বিভাগ কর্তৃক কোনো তদন্তের দিকও সামনে আসছে না। ভারত ছাড়া উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশও একই অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক পাকিস্তানের ইমরান খানকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে পাঠানো, যা কোনো গুরুতর অভিযোগ নয়। আমাদের দেশেও গত নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে বিরোধী দলের নেতাদেরকে সাজা দেওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। বহুবছরের পুরাতন মামলায় দ্রুত সাজা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের অনেককেই নির্বাচনকালীন সময়ে কারাগারে রাখা হয়েছে– যারা এখন প্রায় সকলেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু নির্বাচনকালীন সময়ে তারা কোনো আদালতেই জামিন পাননি।
ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের এবারকার নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। তবে কতটা শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় থাকবে, সেটি দেখার বিষয়। বর্তমানে বিজেপি ও তার জোট তাদের দখলে রাখা আসন ধরে রাখতে পারবে কিনা কিংবা তার থেকে বেশি আসন লাভ করবে কিনা– সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে ভারতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে একথা বলা যায়, আগামী নির্বাচনে যদি বিজেপি আরও বেশি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছায় তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্র আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ও বিভিন্ন দায়িত্বে সংযুক্ত হতে থাকবেন, যা মূলত সরকার প্রদত্ত উপহার হিসেবেই পরিগণিত হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা (উপঢৌকন) বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে এক ধরনের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি করে।
ভারতের কাশ্মীর প্রশ্নে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। কাশ্মীরীদের পক্ষ থেকে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েও তেমন সুবিধা অর্জন হয়নি। রাজ্যটির সরকার ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আগেই ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে নেওয়ার কারণে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে কাশ্মীরের মতামত নেওয়ার দরকার পড়েনি। যদিও ভারতের মনিপুরসহ কয়েকটি রাজ্যে সংবিধানে সিক্স শিডিউল বিদ্যমান যা অনেকটা কাশ্মীরীদের আর্টিকেল ৩৭০এর অনুরূপ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে বিজেপি বিরোধীরা ক্ষমতায় তারাও ৩৭০ প্রশ্নে নিশ্চুপ থেকেছে বরাবর। মুখে বিজেপি বিরোধিতার কথা বললেও কার্যত বিজেপির সাথে সমঝোতা করেই রাজ্য ক্ষমতায় টিকে আছে।
উপমহাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটিতে পৌঁছেছে। এই ২০০ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ প্রায় একই রকম দুর্বল গণতন্ত্রের শিকারে পরিণত হচ্ছে। ফলে উপমহাদেশের তিনটি দেশই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। আয় বৈষম্য তীব্র হচ্ছে। নানা রকম সামাজিক নিরাপত্তার যে সমস্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে, তা দুর্নীতির কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী উপকৃত হতে পারছে না। সবকিছুই হচ্ছে দুর্বল গণতন্ত্রের সামষ্টিক ফলাফল।
এবার দেখা যাক, ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে মানুষ কতটা বিজেপিকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে। আগামীতে ভারতের গণতন্ত্র বিকোশিত হবে নাকি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আরো গেঁড়ে বসবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জুনের ৩ তারিখ পর্যন্ত।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।