‘জাগার থেকে ঘুমোই, আবার ঘুমের থেকে জাগি’
রাতজাগা নিয়ে কথা বললে আপনার কার কথা মনে পড়ে? চারপাশে নিশ্চয় এমন অনেকে আছেন যারা রাত জাগেন। বেশি ঘনিষ্ঠ হলে সময় সময় গভীর রাতে ফোন করে তারা হয়তো একটু-আধটু বিরক্তও করেন। আমার ঘনিষ্ঠ একজন ছিলেন। রাত ১২টার দিকে আমার জন্মদিন ছিল জেনে ঢাকার এক ফাইভ স্টার হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্রিট দেবেন বলে। হোটেলের কোনো রেস্টুরেন্টেই তখন খাবার অবশিষ্ট ছিল না। পরে আমরা গিয়েছিলাম কারওয়ানবাজারের স্টার কাবাবে।
ওই ভদ্রলোক একবার রাত তিনটেের দিকে ফোন করেছিলেন। দাঁতের ব্যথায় কাতর তিনি। তার পরিচিত ডেন্টিস্ট কাউকে পাচ্ছিলেন না। আমার পরিচিতদের কাউকেও পাইনি। শেষ পর্যন্ত এক হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে ব্যথা কমানো হয়েছিল।
আরেকবারও এরকম রাত আড়াইটার দিকে তার ফোন। ফেসবুকে একটা মিথ্যা পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এরকম যে, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের এক সাবেক অধ্যাপককে চিকিৎসার জন্য ভিক্ষা করতে হচ্ছে। তিনি তাকে তখনই সহায়তা করতে চান। হয় নিজে টাকা নিয়ে যাবেন, অথবা কাউকে পাঠাবেন। পরে অবশ্য ঘটনার সত্যতা মেলেনি।
শুধু এরকম দরকারে না, অদরকারেও গভীর রাতে ফোন করতেন তিনি। কখনো কোনো লেখার প্রশংসা করতে। কখনো লেখায় ভুল-চুক হয়ে থাকলে তা ধরিয়ে দিতে। দেশের রাজনীতি বা বিশ্বরাজনীতি নিয়ে কথা বলতেও ফোন করতেন অনেক রাতে। বড়ভাই হিসেবে শেষে নির্দেশ থাকত, পরদিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করার। সেটা অবশ্য সম্ভব হতো না। কোনো না কোনো কারণে তার সঙ্গে সান্ধ্য আড্ডায় খুব বেশি যোগ দেওয়া হয়নি। তিনি চলে যাবার পর এ নিয়ে কষ্ট রয়ে গেছে।
ইনি আমাদের নিকটজনদের একজন। এরকম আরও আছেন। অবাক বিষয় যে, পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ রাতজাগা মানুষগুলোর বেশিরভাগই অসাধারণ মেধাবী। তাহলে কি মেধাবীরা রাত জাগেন বেশি? সৃষ্টিশীল মানুষেরা?
কোনো কোনো গবেষণা দাবি করে, বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ বেশি এমন মানুষেরা রাতে বেশি সক্রিয় থাকেন। ফলে অনেক রাত করে ঘুমোতে যান তারা। যাদের আইকিউ ৭৫ বা তার কম, তারা রাত ১১টা ৪১-এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। আর যাদের আইকিউ ১২৩ বা তার চেয়ে বেশি, তারা রাত সাড়ে ১২টার পরও জেগে থাকেন।
গবেষণা যা-ই বলুক, বাঙালির সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মানুষটি কিন্তু রাত জাগতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘুমিয়ে পড়তেন রাত ১২টার আগে। উঠতেন ভোর ৪টায়। তার আইকিউ কত ছিল সেটা কোথাও পেলাম না। যদিও জানা গেল, স্টিফেন হকিংয়ের আইকিউ বা বুদ্ধাঙ্ক ছিল ১৯০। শারীরিক কারণে হকিংয়ের পক্ষেও রাতজাগা সম্ভব ছিল না।
দেশে-বিদেশে নিজের সম্প্রদায়ের যাদের নিয়ে আমার আগ্রহ, তাদের একজন খুশবন্ত সিং। তাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। বিশেষ করে তার কথিত মদ্যপান এবং তথাকথিত নারীপ্রীতি নিয়ে। সুতরাং অনেকে মনে করতে পারেন যে, তার নিশ্চয় রাতজাগার অভ্যাস ছিল।
আসলেই কি তা-ই?
শুরুতে আমার যে নিকটজনের কথা বলেছিলাম, তার জীবন ৫০-এর আগেই থেমে গেছে। আর খুশবন্ত সিং মারা গেছেন সেঞ্চুরি থেকে মাত্র এক বছর আগে। নিজের আত্মজীবনী এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি তার মদ্যপান এবং নারীপ্রীতি নিয়ে যে বদনাম তার জবাব দিয়েছেন।
খুশবন্ত সিংয়ের ভাষ্যমতে, যেহেতু তিনি যৌনতা নিয়ে এবং মদ্যপানের পক্ষে লেখেন, তাই অনেকে তাকে হেয় করেন।
কিন্তু যে লোকটা ভোর সাড়ে ৪টার সময় উঠে লিখতে শুরু করেন, আর ৮০টার ওপরে বই লেখা হয়ে গেছে; সেরকম একজনের নারীদের নিয়ে মত্ত থাকার সময় কোথায়? 'হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে, অনেক সুন্দরী নারী আমার কাছে আসেন। মদ্যপানের আসরও হয়তো মাঝেমধ্যে বসে। কিন্তু খুব বেশি হলে ১৫–২০ মিনিট সময় থাকলে নিজেই বলে দেই যে, অনেক হয়েছে, এবার আসতে পারেন, কাজে বসতে হবে,' — এরকমই বলে গেছেন খুশবন্ত।
প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠতেন তিনি। সন্ধ্যায় দু'পেগ মদ্যপানও করতেন। কিন্তু রাত ৮টায় ডিনার করে পৌনে ৯টায় ঘুমোতে যেতেন। কখনো এর ব্যতিক্রম হতো না। এমনকি তার বন্ধু জ্ঞানী জৈল সিং যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি, তখনও খুশবন্ত, মতান্তরে খুশবন্তপত্নী, জৈল সিংকে রাত ৮টা বাজার কারণে চলে যেতে বলেছিলেন। কারণ পৌনে ৯টায় খুশবন্তের ঘুমোনোর সময়।
এরকম যারা রুটিন মেনে চলেন, তাদের জন্য তো বটেই; যারা রাত করে ঘুমোতে যান, তাদের জন্যও এক সংকটসময় এসে হাজির হয়েছে। অনেকটা কবিগুরুর শিশু ভোলানাথ-এর 'ঘুমের তত্ত্ব'র মতো। যেখানে তিনি লিখেছেন:
'জাগার থেকে ঘুমোই, আবার
ঘুমের থেকে জাগি—
অনেক সময় ভাবি মনে,
কেন, কিসের লাগি।'
কিসের লাগি আমাদের রাত্রিজাগরণ
বুদ্ধাঙ্ক যা-ই থাকুক, আমরা অনেকে এখন রাতজাগার পাখিতে পরিণত হয়েছি। বিশেষ করে মধ্য জুন থেকে। এটা ২১ জুন থেকে আরও বাড়বে। চলবে মধ্য জুলাই পর্যন্ত। কেন আমাদের এ রাত্রিজাগরণ?
কবিগুরু এরও জবাব দিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন:
'তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়ো,
আমিই জেগে থেকে
নানা রকম খেলায় তাদের
দেব ভুলিয়ে রেখে।'
এই যে তিনি নানা রকম 'খেলা'র কথা বলেছেন, সেটাই আমাদের রাতজাগার পালা নিয়ে এসেছে। পরিণত করেছে রাতের পাখিতে।
২ জুন শুরু হয়েছে টি-২০ বিশ্বকাপ। বুধবার (১৯ জুন) থেকে সুপার-এইট পর্ব। বাংলাদেশের বাঘেরা সেখানে পৌঁছে গেছে। খেলা হবে প্রতিদিন বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৬টা এবং রাত সাড়ে ৮টায়। শুধু ক্রিকেট বিশ্বকাপ হলে কথা ছিল না। মধ্য জুনে শুরু হওয়া ইউরো ফুটবলের ম্যাচ আমাদের সময় সন্ধ্যা ৭টা, রাত ১০টা এবং রাত ১টায়। এর মধ্যে আবার ২১ জুন শুরু হতে যাচ্ছে কোপা আমেরিকা। যেখানে বাংলাদেশিদের প্রিয় দুইদল ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা আছে। কোপার খেলা আমাদের জন্য 'কোপানো সময়ে'। খেলাগুলো হবে ভোর ৪টা, ৬টা এবং সকাল ৭টায়।
সুতরাং, খেলাপ্রেমীদের খেলা দেখতে হলে রাতভর জেগে থাকতে হবে। আর যদি ঘুম পুষিয়ে নিতে চান, তাহলে ঘুমোতে হবে দিনে। কাজ-কর্ম তখন লাটে উঠবে। যারা জীবনটাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য নাইট শিফটে পরিণত করতে চান, তারা না হয় রবীন্দ্রসুরে গুনগুনিয়ে উঠতে পারেন:
'কোন্ সুধা যে চাঁদের আলোয় আজ করেছে পান
মনের সুখে তাই আজ গোপন কিছু নাই,
আঁধার-ঢাকা ভেঙে ফেলে সব করেছে দান।
দখিন হাওয়ায় তার সব খুলেছে দ্বার
তারি নিমন্ত্রণে আজি ফিরি বনে বনে,
সঙ্গে করে এনেছি এই
রাত-জাগা মোর গান।'
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।