রাশিয়া-ইউক্রেন কি আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে এর অন্যতম দুই অংশীদার রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক সব সময়ই একধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান উত্তরসূরী হিসেবে রাশিয়া সবসময় ইউক্রেন সংক্রান্ত বিষয়কে নিজেদের মনে করেছে অন্যদিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের পশ্চিমা ঘেঁষা নীতি। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে এসে ইউক্রেন মোটামুটি দু'পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশলে এগিয়ে চললেও ২০১৪ থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে, কিয়েভের তৎকালীন সরকার ইউরোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বদলে রাশিয়ার পাল্টা প্রস্তাবে সায় দিলে সেখানে দানা বাঁধে ইউরোময়দান আন্দোলন, ক্ষমতাচ্যুত হন রুশপন্থি রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়াও ইউক্রেন থেকে দখল করে নেয় ক্রিমিয়া, যা আবার ১৯৫৪ তে নিকিতা ক্রুশ্চেভের আমলে ইউক্রেন কে উপহার দেওয়ার আগে রাশিয়ারই অংশ ছিলো।
তবে দুই দেশের সম্পর্কের এই তিক্ততা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং কৃষ্ণ সাগর ঘেঁষা ক্রিমিয়ার ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়াও যেমন এক বিন্দু ছাড় দিতে নারাজ, তেমনি সামরিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা ইউক্রেনও ক্রিমিয়া ফিরে পেতে মরিয়া। ক্রিমিয়া বাঁচাতে না পারলেও কিয়েভ প্রতিশোধ নিয়েছে অন্যভাবে। ঠিক হাতে না মেরে ভাতে মারার মত, তারা ক্রিমিয়ার পানি ব্যবস্থার বড় উৎস যা আসে ডিনিপার নদী থেকে, সেখানেই বাঁধ দিয়ে রেখেছে। রুশ অস্ত্রের ঝংকারে ক্রিমিয়ার নিরাপত্তা বূহ্য সুরক্ষিত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে পানির জন্য তারচেয়ে গভীর সংকটে আছে ক্রিমিয়া। পাইপলাইন দিয়ে পানি সরবরাহ করতে ক্রেমলিনকে খরচ করতে হচ্ছে হাজার হাজার রাশিয়ান করদাতার রুবল, খরায় পড়ে থমকে আছে সেখানকার কৃষিখাত। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের পরই কিয়েভ ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। এমনকি এ বছরের শুরুতে ন্যাটো থেকে তাদের পূর্ণ সদস্য হওয়ার ব্যাপারে সবুজ সংকেতও দেওয়া হয়েছিল। যা রাশিয়ার জন্য যথেষ্ট চিন্তার বিষয় যেহেতু এতে চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র নিয়ে তার ঘাড়ে চেপে বসার সুযোগ পাবে।
পুতিন কি এতসব সহজেই মেনে নেবেন?
গত শতকের শেষদিক থেকে রাশিয়ার অবনমনের পিছনে হাজার কারণ থাকতে পারে, তবে মূলকথা হল রাশিয়ানদের মধ্যেই ছিলো চাপা অসন্তোষ তাদের শাসক শ্রেণির উপর। জনগণের জীবনমানের ছন্দপতন তো ছিলোই তবে রাশিয়ার ইতিহাস বলে তাদের জনগনের মনস্তত্ত্ব কঠোর শাসকের প্রতি সহানুভূতিশীল। পুতিন ক্ষমতায় এসে রুশদের এই মনোভাব ধরতে পেরেছিলেন বলেই যখনই তিনি দেশে আস্থা হারিয়েছেন তখনই কোন যুদ্ধের আয়োজনে আবার জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠেছেন।
দেশে-বিদেশে নতুন করে বিপদে পড়ার আগেই তাই এই সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা আবারও যুদ্ধের কার্ড চাললেন। উদ্দেশ্য ইউক্রেনকে শায়েস্তা করে পশ্চিমাদের বার্তা দিয়ে রাখা। এ বছরের শুরু থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে ছোটখাটো সংঘাতের আশংকা করা হচ্ছিলো। তবে বছরের শেষদিকে এসে জানা গেল রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেন সীমান্তে ভারী অস্ত্রসহ ১ লক্ষ্যের অধিক সেনা মোতায়েন করেছে এবং জানুয়ারি নাগাদ হামলা চালাতে পারে। সৈন্য সমাবেশের বিষয়ে মস্কো বলছে, তাদের যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই, তবে রুশ সীমান্তে তারা ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্রের কোন অবস্থান বরদাস্ত করবে না। যুদ্ধের কথা স্বীকার না করলেও ডোনবাস অঞ্চলের ডোনেৎস্ক ও লুহানস্কে রুশপন্থি বিদ্রোহীদের তারা মদদ দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। ইউক্রেনের সাথে এদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাকে গণহত্যা বলে নিন্দাও জানিয়েছেন পুতিন এবং ইউক্রেনের রুশভাষী অঞ্চলগুলিতে এমন উত্তেজনা যুদ্ধের সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দিবে নিশ্চিতভাবে। অন্তত ক্রিমিয়ায় রাশিয়া পানি নিয়ে যে চাপে আছে তার থেকে উত্তরণে তারা যে যুদ্ধের পথ বেছে নিবে না সেটারও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। পরিস্থিতির কিছুটা আচ পেয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ছুটছেন মিত্রদের দরবারে, সেই সূত্র ধরে বাইডেন কথা বলেছেন সরাসরি পুতিনের সাথে। তবে রাশিয়া যে এত সহজেই দমে যাওয়ার পাত্র নয় তা অন্যরা ভালোই জানে এবং এতে করে পরিস্থিতি আরো জটিলই হবে।
আরেকটি যুদ্ধের ভার কি বিশ্ব নিতে পারবে
স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া ক্রমান্বয়ে বিশ্বরাজনীতিতে তার প্রভাব হারিয়েছে, সামনে উঠে এসেছে চীনের মত দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রও ট্রাম্পের আমল থেকে চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মোকাবিলা করছিলো, ভূরাজনৈতিক পরিমন্ডলে পরাশক্তিদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো প্যাসিফিক অঞ্চল এমন অবস্থাকে রাশিয়া তাদের জন্য দেখছে সুযোগ হিসেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম কিছুটা হয়ত ভেঙেছে। তারা আবার মনযোগ দিচ্ছে পূর্ব ইউরোপের দিকে, প্রতিশ্রুত অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট কয়েক ধাপে পৌঁছেছে। ইউক্রেনে সাথে আছে তাদের স্যাঙশন ডিপ্লোম্যাসি। এমনিতেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভালো অবস্থায় নেই রাশিয়া, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়ালেই তাদের জন্য অপেক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। তবে ইউরোপের অনেক দেশই প্রথাগত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। জার্মানি তাদের মধ্যে অন্যতম। সংঘাত বাঁধলে ইউরোপের জ্বালানির ভবিষ্যত উৎস রাশিয়াকে ইইউ জোটের সদস্যরা তাই ক্ষেপাবে কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
অন্যদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়ে পুতিন কথা বলেছেন চীনের শি জিনপিং এর সাথেও এবং কৌশলগত কারণেই চীন রাশিয়াকেই সমর্থন দিবে বলা যায়। সেই হিসাবে দুই অর্থনৈতিক-সামরিক পরাশক্তি চীন-রাশিয়াকে একসাথে মোকাবেলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনভাবেই সম্ভব নয়।
দিনশেষে পরিস্থিতি যার দিকেই যাক না কেন, তবে কথা হচ্ছে মহামারি আক্রান্ত এই বিশ্ব কি নতুন করে আরেকটি যুদ্ধের ভার বইতে পারবে? করোনার থাবায় বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন সংকটে ফেলার আগে বিশ্বনেতাদের উচিত হবে আরো একবার ভাবা কীভাবে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা যায় রাশিয়া-ইউক্রেনের এই সংঘাত।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।