আসলে কাওয়ালি কী
কাওয়ালি সুফী দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুফি দর্শনে পরম সত্যের স্মরণ এবং তার মাধ্যমে বাহ্যিক অস্তিত্বকে নিজের সাধনার দিকে আরও মনোনিবিষ্ট করবার জন্য সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রথমদিক থেকে সুফীদের সাধনার মধ্যে সামা নামের একটি অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। সাধারণত সন্ধ্যার পর সুফীদের খানকা শরীফে তাদের সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত বাণী (এই বাণীকে 'কওল' বলা হয়, এটি একটি আরবি শব্দ) বারবার উচ্চারণ করে, কখনো কখনো এর সঙ্গে ভাবে অবলুপ্ত হয়ে সুফীরা তাদের সাধনাকে মনোনিবিষ্ট করবার জন্য এই অনুষ্ঠান করতেন। অনুষ্ঠানটি মধ্য ইরাকে, মিশরে, মরক্কোতে সুফিদের মধ্যে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল। এই ধারণাটিই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট স্থানীয় ভাবনা-চিন্তা, দর্শন এবং সঙ্গীতের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সামার ধারণাটিই ভারতবর্ষে এসে সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে, যা বর্তমানে কাওয়ালী নামে পরিচিত।
তবে কাওয়ালিকে শুধু মাত্র সঙ্গীতের একটি ধরন মনে করলে ভুল হবে। ভারতবর্ষে সুফীরা তাদের প্রেমের দর্শন প্রচার শুরু করলেন। তখন একদিকে ছিল দরবারভিত্তিক বা রাজশক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত ধর্মের প্রচলিত রূপ। অন্যদিকে ছিলেন সুফীরা। সুফীরা, বিশেষ করে চিশতিয়ারা ছিলেন জনসংশ্লিষ্ট। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত চিন্তা, সঙ্গীতের বিভিন্ন যে ধরন সেগুলোই সংযুক্ত হয়ে কাওয়ালী রূপ পায়। ভারতবর্ষে কাওয়ালীর জনক হিসেবে জনপ্রিয়ভাবে আমির খুসরু পরিচিত। নির্দিষ্ট কোন সঙ্গীত বা ধারণা একক ব্যক্তি সাধারণত প্রচলিত করেন না। তারা সাধারণত জনমানুষের মধ্যে প্রচলিত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে থাকা কোনো চিন্তা বা প্রবণতাকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেন। খুব সম্ভবত আমি খুসরুও ভারতবর্ষের সুফীদের মধ্যে প্রচলিত প্রবণতাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেছিলেন। ক্রমে তাঁকেই ভারতবর্ষে কাওয়ালীর জনক বলে চিহ্নিত করা হয়।
আমির খুসরু নিজে ছিলেন চিশতিয়া সুফী ঘরানার একজন শিষ্য। তিনি বাস করতেন দিল্লীতে, ছিলেন ফারসি ভাষার বড় একজন কবি। একইসঙ্গে ছিলেন খুব বড় মাপের একজন সঙ্গীতঙ্গ, সেইসঙ্গে ছিলেন বড় ইতিহাসবিদও। আমির খুসরুর গুরু ছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। বলা হয়ে থাকে, নিজামউদ্দিন আউলিয়া যখন একবার খুব বিমর্ষ হয়েছিলেন। গুরুর বিমর্ষতা কাটানোর জন্য আমির খুসরু কয়েকজন শিশুকে বেছে নেন। 'কওল' অর্থাৎ ভাব সম্পদে খুবই গভীরভাবে প্রোথিত কিছু বাণী সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন করেন। সেগুলোকে তিনি তৎকালীন সময়ের প্রচলিত ধ্রপদ ঘরানার মধ্যে বাধেননি। লক্ষ্য করতে হবে যে, ভারতবর্ষে সে সময় প্রচলিত ছিল মার্গীয় সঙ্গীত ছিলো ধ্রুপদ। ধ্রুপদ ছিল খুব নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনে বাঁধা। এরমধ্যে নতুন কিছু করার সুযোগ ছিল খুব কম।
তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত সঙ্গীতের চলন বেছে নেন। সেগুলোকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত সুরে লিপিবদ্ধ করেন। বাণী রচনা করেন সেইসময়ে দিল্লির আশে-পাশে মানুষের মুখের প্রচলিত বুলিতে। এই সঙ্গীতে বাছাই করা কয়েকজন শিশুদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। পরবর্তীকালে তার গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সামনে ওই শিশুদের দিয়ে গানগুলো গাওয়ান। কাওয়ালির সূত্রপাতটা হয় এভাবেই।
পরবর্তীকালের কাওয়ালির যেসব ঘরানাদার গায়ক, তারা নিজেদেরকে ওই সেই প্রথম কাওয়ালী গায়ক শিশুদের কোনো না কোনো একজনের সঙ্গে তাদের ঘরানাকে, তাদের বংশপরম্পরাকে সংযুক্ত করেন। আমির খুসরু যাদেরকে কাওয়ালীর দীক্ষা দিয়েছিলেন তাদেরকে ঘিরেই পরে ধ্রুপদের বাইরে একটি 'খেয়াল' ঘরানা গড়ে ওঠে। এই ঘরানাকে দিল্লি ঘরানা বা কাওয়াল বাচ্চা ঘরানা নামেও অভিহিত করা হয়।
কাওয়ালি গাওয়ার কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে একজন মূল গায়ক থাকেন, তার সঙ্গে সহগায়ক থাকেন, তালযন্ত্র থাকে, এবং সেইসঙ্গে বর্তমান সময়ে এসে হারমোনিয়াম যুক্ত হয়েছে। এখানে খুব গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তালযন্ত্র। পেছনে দোহাররা থাকেন, এই দলটি মূল কাওয়াল বা গায়ক ও সহগায়কের সঙ্গে সঙ্গে আখর যোগান। অর্থাৎ গানের যে বাণীগুলোকে কাওয়ালরা গেয়ে থাকেন, একই তালে ও সুরে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন।
কাওয়ালি শুধুমাত্র উর্দুতে গাওয়া হয় না। বরং মূলত ফার্সি, উর্দু, পাঞ্জাবি ভাষায় গাওয়া হয়ে থাকে। গাওয়া হয় আরবিতে, ব্রজ ভাষায়, আওধিতে। কাওয়ালি মূলত প্রেমের কথা বলে। সব রকমের প্রচলিত ধারণা, বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে প্রেমকে পাথেয় জেনে সত্যকে হৃদয়াঙ্গম করা, সত্যের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলার আকুতিই কাওয়ালির প্রধান বিষয়বস্তু।
প্রচলিত ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান বিধি-নিষেধে মানুষকে আটকে রাখে। সেগুলোকে অতিক্রম করে প্রেমের মাধ্যমে সত্যকে আবহন করার বাণীই কাওয়ালি। গাওয়া হয়ে থাকে সুফী সাধকদের যে দরবার থাকে সেগুলোর মধ্যে। বিংশ শতাব্দীতে বিনোদন খাতের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে কাওয়ালি রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অথবা কনসার্টের মাধ্যমেও চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যারা ঘরানাদার কাওয়ালি, অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে সেই সুদীর্ঘ কাওয়ালীর ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেন, তাদের বাণী, গাওয়ার নির্দিষ্ট ঐতিহ্য সুনির্দিষ্টভাবেই ঐতিহাসিক পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত। প্রত্যেক ঘরানাদার কাওয়ালি তাদের নিজেদেরকে আমির খুসরু থেকে ভারতবর্ষে চলে আসা পরম্পরার সঙ্গে সংযুক্ত করেন। আমরা যেসব বড় বড় কাওয়ালদেরকে চিনি- নুসরাত ফতেহ আলী খান, সাবরি ব্রাদার্স, ওয়ারসি ব্রাদার্স- তাদের প্রত্যেকেরই কাওয়ালির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। শুধু পরিবেশনা নয়, কাওয়ালির যে বিষয়বস্তু, বাণী তারা পরিবেশন করে থাকেন তাঁর মাঝে অর্জিত নিজস্বতা তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কাওয়ালি কোনো স্থবির শাস্ত্রবদ্ধ বিশ্বাসের সুনির্দিষ্ট গৎবাঁধা পথে এগোয় না। রাজ দরবারে অথবা শাস্ত্রবদ্ধ যে সঙ্গীতের রূপ ছিল কাওয়ালী সেটি গ্রহণ করেনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাবনা, সঙ্গীত প্রবণতা, জীবনের অর্থ অন্বেষণের যে প্রক্রিয়া আর বৈশিষ্ট্য ছিল, সে বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করেছে কাওয়ালি। সাধারণ মানুষ জীবনের প্রতিকূল সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জীবনের আপাত তুচ্ছতার মধ্যে থেকেও নিজেকে এই যাপিত জীবনের চাইতে বড় কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত করার আকুতি বোধ করে। জনমানুষের সেই আকুতির এক সুস্পষ্ট প্রকাশ কাওয়ালি। সর্বমানুষের মুক্তি খোঁজার যে প্রয়াস, সে প্রয়াসেরই অত্যন্ত শক্তিশালী ধারা এই সঙ্গীত।
- জাভেদ হুসেন: লেখক, অনুবাদক