মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য: ইতিহাসের পুরনো কৌশল
গত ডিসেম্বরে ডানপন্থী হিন্দু সন্ন্যাসী ও কর্মীদের এক সম্মেলনে হিন্দু মহাসভার নেতা পূজা শকুন পান্ডে ঘোষণা দেন, 'আমাদের ১০০ জন যদি ওদের ২০ লাখকে হত্যা করতে প্রস্তুত থাকি, তাহলেই আমরা জয়ী হয়ে ভারতকে হিন্দু জাতিতে পরিণত করতে পারব।'
তার এই প্রকাশ্য গণহত্যার ডাক ক্যামেরায় ধরা পড়ে। তারপর সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। এরকম প্রকাশ্য ঘৃণা প্রদর্শনের নিন্দায় মুখর হয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াও। এ ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই একই পুলিশবাহিনী ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করলেই পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়াই অধিকারকর্মী ও কৌতুক অভিনেতাদের গ্রেপ্তার করেছে।
এ ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ২০১৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির বিরোধী দলগুলোও শকুন পান্ডের মন্তব্যের সমালোচনা করেছে অনেকটাই রয়েসয়ে। ভারতে সবচেয়ে ভোটিং ব্লক হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী। তাই স্বাভাবিকভাবেই কেউই এই ব্লকের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইবে না।
তবে এটা নতুন কিছু নয়। এরকম বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা ভারতে নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে হাজার হাজার মানুষকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতাধর ধর্মীয়, জাতিগত ও রাজনৈতিক নেতারা এরকম ঘৃণা ছড়ানো কথাবার্তা নিয়মিতই বলে চলেছেন।
এনডিটিভির ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদি সরকারের আমলে ভারতে ভিআইপিদের ঘৃণা ছড়ানো কথার পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়েছে। এরকম বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের হার বেড়েছে ৫০০ শতাংশ।
বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী নেতারা এবং খোদ বিজেপি নেতারাও ভোটারদের ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকে দেওয়ার জন্য ঘৃণামূলক কথা বলে যাচ্ছেন।
পূজা শকুন পান্ডের মতোই তাদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি কিংবা কেউই গ্রেপ্তারও হননি। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছ থেকে মৌন সুরক্ষা পেয়েছেন তারা।
এই নীরবতা ও মৌন সুরক্ষার সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ, বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দায়মুক্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর এই ধাক্কা সইতে হয়েছে ভারতের সংখ্যালঘুদের।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক দশকে ভারতে সংঘটিত সমস্ত ঘৃণামূলক অপরাধের প্রায় ৯০ শতাংশই ঘটেছে নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে। অনেকেরই সন্দেহ, স্বয়ং মোদিই ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছিলেন। আর তা করার জন্য তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
নির্দিষ্ট কয়েকটি ঘটনার কথা বলা যাক। ২০১৯ সালে ঝাড়খণ্ডের মুসলিম যুবক তাবরেজ আনসারিকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল হিন্দু। এর কয়েকদিন পর হাফিজ মোহাম্মদ হালদার নামে একজন শিক্ষককে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ২২ বছর বয়সি মুসলিম যুবক রাহুল খানকে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে কয়েকজন যুবক ইন্টারনেটে মুসলিম নারীদের নিলামে বিক্রি করার একটি অ্যাপ ছাড়ে। গুগলে সার্চ দিলেই এরকম আরও অজস্র ঘটনা পাওয়া যাবে।
তবে এরকম ধর্মীয় বিদ্বেষের চর্চা উপমহাদেশে নতুন নয়। এই ঘৃণার জন্ম দেওয়ার জন্য দায়ী করা যেতে পারে ব্রিটিশদের। 'ভাগ করো, শাসন করো' নীতি অবলম্বন করে মোটাদাগে প্রথম ঘৃণার বীজ পুঁতে দিয়েছিল তারা।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম সৈন্যরা ভাইয়ের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিল। সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিমদের মৈত্রী দেখে আতঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশরা প্রতিজ্ঞা করেছিল এরকম কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া হবে না।
এই প্রতিজ্ঞার ফলশ্রুতিতে 'ভাগ করো, শাসন করো' নীতির আওতায় শাসন ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনে ব্রিটিশরা। এসব পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেকোনো ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া।
প্রথমেই ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সম্পূর্ণ দায় মুসলমানদের কাঁধে চাপিয়ে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়। মুসলমানদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাদের বাড়তি নজরদারিতে রাখা হয়।
পরিস্থিতি আরও খারাপ করার জন্য ব্রিটিশরা পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচন চালু করে। এর ফলে মুসলিম ভোটাররা শুধুমাত্র মুসলিম প্রার্থীদের ভোট দিতে পারত। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে যখন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে দায়িত্ব ছেড়ে দেয় এবং তাদের জায়গায় ব্রিটিশরা অনির্বাচিত মুসলিম লীগকে এনে বসায়। ব্রিটিশরা মুসলিম লীগকে ক্ষমতা প্রয়োগে প্রকাশ্যে সাহায্য করে। অন্যদিকে কারাগারে ধুঁকে মরতে থাকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা।
কাজেই বিগতযৌবনা ব্রিটিশ রাজের উপমহাদেশ ছাড়ার সময় অসন্তোষ, অবিশ্বাস ও ভুল তথ্যের বীজ এমনই গভীরে প্রোথিত হয়েছিল যে মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র দাবি করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। তাদের দাবি মেনে নেয় ব্রিটিশ রাজ। এরপরই ঘটেছিল রক্তাক্ত বিভাজন। তার হাত ধরে আসে বিদ্বেষ, জাতিগত সহিংসতা, ধর্ষণ, দাঙ্গা এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে প্রকাশ্যে গণহত্যা।
পরবর্তী কয়েক দশকে ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ চরমে পৌঁছায়। দুই দেশ জড়ায় একাধিক যুদ্ধে। কাশ্মীর উপত্যকাতেও দখল জমায় দুই দেশ। দীর্ঘ এ সময়ে ভারতের হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যার ভেতরও একে-অপরের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস লাভ করে চরম মাত্রা। এর ফলে হয়েছে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সহিংসতা। এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল উগ্রবাদী হিন্দুদের হাতে বাবরি মসজিদ ধবংসের পর ১৯৯২ সালের অযোধ্যা হত্যাকাণ্ড।
অতীতে ভারতের সরকারগুলো ধর্মীয় পুঞ্জিভূত ঘৃণাকে সাধারণত আনুষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ এড়িয়ে চলেছে; কিন্তু ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পুরোনো সেই নীতিকেই যেন প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার।
কোটি কোটি বেকার যুবককে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া, অর্থনীতি পুনর্গঠন ও দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জিতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে মোদির বিজেপি। তবে বলাই বাহুল্য, এসব অঙ্গীকার পূরণে তারা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
মোদি সরকারের নোট বাতিল ছিল এমনই এক বিপর্যয়কর পদক্ষেপ। মহামারি ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার ফলেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে লাখ লাখ ভারতীয়। অর্থনীতির ওপর নেমে আসে চরম আঘাত। তার ওপর আবার বছরব্যাপী কৃষক আন্দোলনে বিপুল জনসমর্থন হারান মোদি।
কৃষকদের দাবির মুখে মোদি হার স্বীকার করলেও, সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের নির্বাচনে তার ব্যর্থতার কথাও মানুষের মনে রেখাপাত করেছে।
সংখ্যালঘু মাত্রই দুর্বল। তাই সব ব্যর্থতা ঢাকার বলিও তারাই। জনতার নজর এসব ব্যর্থতা থেকে সরাতে তাদের মতো যোগ্য 'বলির পাঁঠা' আর কে-ই বা হবে? সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঘি ঢেলে সংখ্যাগুরু ভোটারের সমর্থন আদায় করার পাশাপাশি নিজের সব ব্যর্থতার দায় মুসলমানদের ওপর চাপানোর চেয়ে ভালো কৌশলই বা কী আছে?
তাই এ কথা প্রায় নির্ভার হয়েই বলা যায়, উত্তর প্রদেশের সম্মেলনে পুজা শকুনের দেওয়া হিংসাত্মক বক্তব্য শুধু ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত অহমিকা থেকে আসেনি। বরং এর পেছনে আরও কুটিল লক্ষ্য রয়েছে। যে লক্ষ্য হিন্দু ভোটারদের সমর্থন টানার, জাতীয় আলোচনা থেকে অর্থনৈতিক দুর্দশাকে সরিয়ে ফেলার এবং বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা থেকে জনতার মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টারই অংশ।
জাতীয় ঐক্য ভেঙে শাসন করতে ভারতীয় উপমহাদেশে চিরকালই শাসন ব্যবস্থার এক শক্তিশালী ও ন্যাক্কারজনক অস্ত্র ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ব্রিটিশরা প্রথম যার বীজবপণ করে। তারই ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান এ দুই রাষ্ট্রের।
ঘৃণার সেই বীজ আজ জনতার মনে মহীরুহে রুপ নিয়েছে, সেই বিষবৃক্ষকে আরও পুষ্টকারী সর্বশেষ শাসকদলই হলো মোদির সরকার। কারণ ব্রিটিশ রাজের মতই তারাও জনতার ঐক্যকে ভয় পায়। তাদের জানা আছে, তাদের ব্যর্থতা নিয়ে জনতা ফুঁসে উঠলে মোদি সরকার পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।