ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছাকে উসকে দিয়ে যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে আমেরিকা
প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, চলমান যুদ্ধটি রাশিয়ার আক্রমণ এবং ইউক্রেনের প্রতিরোধ। ন্যাটোর প্রতি যে ভরসা নিয়ে ইউক্রেন প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিল বাস্তবে তা ঘটেনি। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। এক পক্ষের আক্রমণ ও অন্যপক্ষের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে যুদ্ধটি দুই সপ্তাহ অতিক্রম করল। যুদ্ধ শুরুর দুই সপ্তাহ পর এসে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে। তুরস্কের আন্তালিয়ায় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে মিলিত হবেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আশা করছেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দরজা খুলতে পারে। যদিও সাময়িক যুদ্ধবিরতি খুব একটা কাজে আসেনি। ইউক্রেনের রাজধানীসহ সব গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নেবার জন্য সাময়িক যুদ্ধবিরতির মধ্যেও মর্টার শেল ও গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে।
গতকালই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভারভ তুরস্কে পৌঁছেছেন। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রা কুলেবা রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, অভিযোগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে খোলামন নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এই মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখা অপর দেশ ইসরায়েল আজকের বৈঠকের ব্যাপারে একই আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির সমাধানসূত্র অবশ্যই বের হয়ে আসবে। তবে দুই পক্ষের মধ্যেই নমনীয় সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাশিয়া এখন কেবল দোনবাস অঞ্চলকে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলছে। যদিও এর আগে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইউক্রেন ন্যাটোর মতো কোন জোটে অংশ নেবে না, এমন ঘোষণা দিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সুরও পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার বিষয় নিয়ে আর গুরুত্ব দিতে চান না। এর আগে তিনি ন্যাটোর ভূমিকা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। ইউক্রেন ধারণা করেছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার প্রশ্নে ভীষণ শীতল এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বৈরিতামূলক। এর বড় কারণ, জো বাইডেন মনে করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রথমবার ক্ষমতায় আনতে এবং পরেরবার ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করাতে রাশিয়া সহযোগিতা করেছে। জো বাইডেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছাকে উসকে দিয়ে এই যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে আমেরিকা। অন্যদিকে ইউক্রেন ভেবেছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ন্যাটো ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইতিহাস এই সরল রেখায় এগোয়নি। মূলত ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা এবং মার্কিনীদের 'মিথ্যা' আশ্বাস এই যুদ্ধের মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়।
ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে পোল্যান্ডে মিগ টুয়েন্টি নাইন সরবরাহ নিয়ে। যুদ্ধ কোনদিকে গড়াবে, পরিণতি কী হবে, তার কোন কিছুই এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। কিন্তু বিশ্বকে আবার নতুন করে দু'ভাগে বিভক্ত করা হল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমাদের মতন দেশগুলো তার অংশীদার হয়নি। স্নায়ুযুদ্ধের সমস্ত বিষয়টি সীমিত ছিল ইউরোপের মধ্যে। কিন্তু এবারকার ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ এবং তাতে ন্যাটো ও মার্কিনীদের ভূমিকা পৃথিবীর বহু দেশের উপর এক বড় ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যে ৩৫টি দেশ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্ষম দেশ হচ্ছে চীন। তারপরের অবস্থান ভারতের। বাকি দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা এমন নয় যে, তারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও আর্থিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারবে। যদিও বিশ্বায়নের এই যুগে কোন দেশই দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থেকে টিকে থাকতে পারবে না। রাশিয়া আর্থিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও কেবল অবরোধের ঘোষণায় রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। গোটা পৃথিবীর আর্থিক ব্যবস্থার একে অন্যের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা। বিচ্ছিন্ন করে ভাবার সুযোগ নেই।
জ্বালানি তেল এবং কয়লা রপ্তানিতে নতুন করে অবরোধ জারির প্রেক্ষিতে রাশিয়া পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে, ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই খাদ্য বাজারের উপর প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন থেকে গম না আসায় গমের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। গ্যাস এবং জ্বালানী তেলের উপর সরকার বহুদিন যাবত ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছিল। কয়েকদিন আগে সরকার প্রধান গ্যাস ও বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। তার পরেই ইউক্রেনের যুদ্ধ। পরিণতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস জ্বালানী তেল রকেটের গতিতে উপরের দিকে চলছে। শুধু গ্যাস ও জ্বালানি তেল নয়, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের মতন উদীয়মান অর্থনীতির একটি দেশ, মূলত আমদানি নির্ভর। খাদ্যশস্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আমদানি নির্ভর। মাঝে মাঝে আমরা চালের উৎপাদন সক্ষমতা দেখালেও বাজারের অন্যান্য সবকিছুতে আমরা আমদানি নির্ভর হয়ে আছি। বাজার যে ঊর্ধ্বমুখী তার প্রতিক্রিয়া আমরা বাজারে দেখছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ১৪১টা দেশ ন্যাটোর পক্ষে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সেই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংকট কতটা? বৃহৎ দেশগুলো হয়তো মূল্যস্ফীতি রোধ করার নানান কৌশল প্রয়োগ করে নিজের অর্থনীতিকে রক্ষা করবে। কিন্তু এই ১৪১ এর সবাই কি এই অবস্থার হাত থেকে মুক্তি পাবে? অবশ্যই না।
ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কি চাপ সৃষ্টি হবে সেটিও একটি দেখার বিষয়। যদিও খাদ্যশস্যে ভারত পৃথিবীর অন্যতম সরবরাহকারীদের তালিকায়। নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা দিয়ে সংকট হতে রক্ষা করতে পারবে। আমাদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ আটকে যাবে। এর পরিণতিতে আমরা আর্থিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো সেটিও আমাদের দেখার বিষয়। আমরা রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কের কারণে কৃতজ্ঞ বটে কিন্তু এই যে রাশিয়ার নিজস্ব সংকটের ফলে আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ যদি সংকটে পড়ে তার দায়ভার কার উপর বর্তাবে? ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, রাশিয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ থেকে টাকা না পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এবং তার জন্য কোন পেনাল্টি বা সুদ প্রয়োগ না করার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন, উল্টোদিকে রাশিয়া যদি ঠিক সময় মতন এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে না পারে তাহলে তার বিপক্ষে আমাদেরকে ক্ষতিপূরণ কে দিবে? নিশ্চয়ই রাশিয়া। সে ব্যাপারে রাশিয়া আমাদের সরকারকে সরাসরি কিছু বলেনি। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এখন দক্ষতার সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে এই কূটনীতিক সমঝোতা থাকা দরকার।পশ্চিমা যেভাবে বিশ্ব রাশিয়ার উপরে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করেছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে এই অবস্থা থেকে রাশিয়া মুক্তি পাবে এবং আমাদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সময়মতো শেষ করে হস্তান্তর করবে, এমনটি বলা যায় না।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস আমাদের পোশাকশিল্প। সেই পোশাক শিল্পের কাঁচামাল তুলা। নানাবিধ কারণে আজ তার বাজারমূল্য আকাশ ছোঁয়া, গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যস্ফীতি এবং তার সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের পোশাক শিল্পের চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক হারে আমাদের দেশ নতুন সুতাকল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাও পড়েছে মারাত্মক সংকটে। বিশ্ববাজারের এই সংকটের ফলে চাহিদা মোতাবেক মেশিন পাচ্ছে না উদ্যোক্তরা। ব্যাপক 'সময়ক্ষেপণে'র ঘটনা ঘটছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে উৎপাদিত সুতা কাপড় শিল্পের জন্য যে মেশিন ছয় মাস থেকে সাত মাসের মধ্যে সরবরাহ করা হতো তা প্যানডেমিকের ফলে দুই বছরের অধিককাল সময় লাগছে। সবকিছু বিবেচনা করলে আজকে ইউক্রেন রাশিয়া এবং ন্যাটোর যে লড়াই এই লড়াইয়ে আমাদের মতন নিরপেক্ষ দেশগুলোর চূড়ান্ত সংকট সামনে আসছে।