আমেরিকার গণহত্যার ঘোষণা কি রোহিঙ্গা সংকটের মোড় ঘোরাবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ে জার্মানিতে ইহুদি নিধন স্মরণে ওয়াশিংটনে স্থাপিত হলোকাস্ট জাদুঘরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি ব্লিনকেন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনাকে 'জাতিগত নিধন' হিসেবে অভিহিত করেছিল।
মার্কিন আইনে গণহত্যার বিষয়ে কোন দেশ গণহত্যায় যুক্ত প্রমাণিত হলে সেখানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হতে পারে । অভিযুক্ত দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বরাজনীতির আঙ্গিকে মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। মার্কিন প্রশাসনের এই উপলব্ধি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গা সহযোগিতা নিয়ে যে সব দেশ কাজ করছে তাতে উৎসাহ জোগাবে।
তবে সময়টা বড় গোলমেলে ও জটিল। আরো জটিল এখনকার বিশ্বরাজনীতি। বাংলাদেশ – যুক্তরাষ্ট্র অষ্টম অংশীদারিত্ব সংলাপে অংশ নিতে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড এখন বাংলাদেশ সফর করছেন। বাংলাদেশকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর কৌশল আইপিএস যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে লাভবান হতে পারে বলে নুল্যান্ড উল্লেখ করেছেন।
যদিও বিশ্বের নজর এখন ইউক্রেন এবং রাশিয়ার দিকে। তুরস্ক কয়েকদিন ধরেই আশার কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন নাকি সমঝোতার 'দ্বারপ্রান্তে'। যদিও এই সমঝোতার বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি। ন্যাটো তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইউরোপের পূর্বদিকের সম্প্রসারণ অব্যহত রাখার যে কৌশল সেটা কি ইউক্রেন ঠেকাতে পারবে? ইউক্রেনের ঐ জোটে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাটাইতো এই যুদ্ধের 'প্রাণভোমরা'। যদিও জেলোনস্কি এখন আর ন্যাটোতে যোগ দিতে চান না বলে জানিয়েছেন।
রাশিয়া ইউক্রেন মতান্তরে রাশিয়া ও ন্যাটোর এই যুদ্ধটাকে যুক্তরাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে চায়। গোটা বিশ্বে কৌশলগত বিন্যাস এমনভাবে সাজাতে চায় যেন সামারিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব মার্কিনিদের হাতে থেকে যায়। ঠিক তেমন একটি সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধ অবস্থান মার্কিনিদের অস্থির করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে।
ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ প্রসঙ্গে আমাদের এই অঞ্চলের দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ একই কাতারে। যুদ্ধ প্রশ্নে মার্কিন প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর তালিকায় এদের অবস্থান। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া থেকে ভারত অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে নিজস্ব মজুত গড়ে তুলছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চীন কেবল রাশিয়া থেকে নয় মধ্যপ্রাচ্য থেকেও জ্বালানি সংগ্রহ করতে চায়। সৌদিআরব সহ কয়েকটি দেশ ডলারের পরিবর্তে চীনের নিজস্ব মূদ্রায় জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে। পাকিস্তানও একই পথে হাঁটতে চায়। তাহলে কি এই অঞ্চলের সামগ্রিক অবস্থান কী মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে?
গত সপ্তাহে পাঞ্জাবের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বেশ ক্ষোভের সাথেই বলেছেন, মার্কিন ও পশ্চিমের নেতারা আমাদের তাদের 'দাস' মনে করে। তারা ধরেই নেয়, আমরা তাদের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষোভের কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। মার্কিনিরা ভাল করেই জানে কখন কাকে ধরতে হয়। এই সময়ে চীন ও ভারত প্রশ্নে 'নিরব' থাকলেও পাকিস্তান প্রশ্নে কেন বসে থাকবে? মার্কিন ও পশ্চিমাদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মাশুল বোধহয় দিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আগামী ২৫ মার্চ শুক্রবার আস্থাভোটের মুখোমুখী হচ্ছেন ইমরান খান।
বাংলাদেশ সামগ্রিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যলোচনায় রেখেছে তা বোঝা যায়, চলমান যুদ্ধ অবস্থা নিয়ে অতিউৎসাহী কোন অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশ বরং তার নিজস্ব পররাষ্ট্র নীতিতে অবিচল থেকেছে। সেকারণেই বাংলাদেশ কোন পক্ষে অবস্থান না নিয়ে ভোটদানে বিরত থেকেছে। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির সাথে সাক্ষাতে পররাষ্ট্র সচিব সে কথাই বলেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের এই মাঝামাঝি অবস্থান তার অর্থনীতি একটু 'ঝুঁকিতে' ফেললো কিনা। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় সবটা বিশেষ করে তৈরি পোশাক ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ, আমেরিকা আমাদের উন্নয়ন অংশীদার। চীন এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের চলমান বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি।
চীন- মার্কিন বিভাজন রেখা যতই স্পষ্ট হোক না কেন, মার্কিন জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পণ্য সরবরাহ করে চীন। এই বাজার এখন চীনের দখলে। মার্কিনিরা এইসকল পণ্যের উৎপাদন বহু আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বৈরিতার মধ্যেও অর্থনীতি তার নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নেয়। এই অর্থনীতির ভিত্তি হল, পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা। যেমন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় আমরা আস্থা রাখতে চাই। আমরা আশান্বিত হতে চাই, এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হবে। বাংলাদেশ সবমিলিয়ে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে কেবল মানবিক বিবেচনায় এদেশে আশ্রয় দিয়েছিল। এই জনগোষ্ঠীর উচ্চ জন্মহারের কারণে ইতোমধ্যে এই সংখ্যা ১৭ লাখে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ঐ অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ আজ বিপন্ন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংখ্যানুপাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। স্থানীয়রা সেখানে এখন সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়েছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার বাংলাদেশের জন্য সত্যি অসহনীয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠার সমস্যাটির সমাধান হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা মানবিক মর্যদা নিয়েই নিজভূমিতে ফিরতে পারবে আমরা সেই প্রত্যাশা করতে চাই।