গণতন্ত্র চর্চার অনুপস্থিতিই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ?
উপযুক্ত গণতন্ত্র চর্চার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদানের একটি হল, রাষ্ট্রে গণতন্ত্র চর্চার অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতেন্ত্রর প্রতি সংবেদনশীল জনগণ। এই দুই উপাদানের যেকোনো একটির বা উভয়ের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি প্রতিকূল। পাকিস্তানে বরাবরই এই দুটি উপাদান অনুপস্থিত। সম্প্রতি বেশ কিছু দিন ধরে চলমান নাটকীয়তা শেষে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানোর পর, দেশটির ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তবে এখানেই নাটকীয়তার শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পতনের বিরোধিতা করে এখন পাকিস্তানের সাতটি শহরে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর অনিশ্চয়তাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে; সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তান হয়েছে উঠেছে আলোচনার অন্যতম বিষয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ জন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেছেন দেশটিতে। এরমধ্যে ২২ জনই প্রধানমন্ত্রীর পদের পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ ক্ষমতায় কাটাতে পারেননি। আবার এই ৭৫ বছরে সামরিক শাসন ছিল প্রায় ৩৩ বছর। সর্বোচ্চ সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ডও কেবল ওই সামরিক শাসকদের। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে, কখনও লোক দেখানো নির্বাচন করে, আবার কখনও ছায়া গণতন্ত্রের প্রহসন করে ক্ষমতায় থেকেছেন। কোনো রাষ্ট্রে যদি এমন দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন চলতে থাকে, তবে সে রাষ্ট্রে গণতেন্ত্রর জন্য অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতেন্ত্রর প্রতি সংবেদনশীল জনগণের বিকাশ হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। সামরিক শাসকদের শাসনামলে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে, ঠিক তেমনি অভ্যন্তরীণ প্রাদেশিক সংকট এবং বর্ণবাদকে ধামাচাপাও দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, যে সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন ছিল, সে সময় রাষ্ট্র প্রধানদের কেউ কেউ ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বাহিনীর মদদে, আবার কেউ কেউ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ওই একই সামরিক বাহিনীর চাপেই।
গণতান্ত্রিক শাসনামলের আলোচনা করতে গেলে আবার গণতান্ত্রিক শাসকদের প্রসঙ্গ চলে আসে। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শাসকদের মধ্যে গণতন্ত্রকে লালন করার বা তার বিকাশ ঘটানোর প্রবণতা খুব একটা ছিলনা কখনই। ক্ষমতাসীনরা, সে যেই রাজনৈতিক দলেরই হক না কেনো, বরাবরই তারা প্রচণ্ড দুর্নীতিপ্রবণ এবং স্বজনপ্রীতির দোষে দুষ্ট ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই ছুটেছেন কেবল ক্ষমতার পেছনে। এই ক্ষমতাকে তারা মনে করেছেন নিজের জন্মগত কিংবা পারিবারিক অধিকার। আবার কারও কারও জন্য এই ক্ষমতা কেবলই ব্যবসায়ে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ভুট্টো পরিবারের কথা। এটি মোটামুটি পরিষ্কার যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনের ধরন গণতান্ত্রিক নয় বরং ছিল রাজতান্ত্রিক ধাঁচের। এমনকি তার উত্তরসূরি বেনজির ভুট্টোর মাঝেও এই দাম্ভিকতা প্রতিফলিত হত। অন্যদিকে, নওয়াজ শরিফ স্বনামধন্য শিল্পপতি পরিবার থেকে যোগ দেন রাজনীতিতে। ভুট্টো তাদের শিল্প ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার পরেই শরিফ পরিবার জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে, যা পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমিতে একেবারেই স্পষ্ট। অর্থাৎ, তাদের কারও মধ্যেই গণতেন্ত্রর জন্য অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং গণতেন্ত্রর প্রতি জনগণকে সংবেদনশীল করার চেষ্টা বা ইচ্ছা কোনটিই ছিলনা, শুধু ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তা ও চেষ্টা।
বর্তমান পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে, ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। ১৯৯৬ সাল থেকে ইমরান খান তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি একজন জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেটার হওয়া সত্যেও রাজনীতিতে তার জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে সময় লেগেছে অনেক। তবে ২০১৮ সালে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে, পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির মত প্রধান দুই দলকে হারিয়ে তার দল নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। ইমরান খান ক্ষমতায় আসায় অনেকে মনে করেছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এবার আমূল পরিবর্তন আসবে; গণতন্ত্র চর্চার রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে; সেইসঙ্গে গণতেন্ত্রর প্রতি সংবেদনশীল হবে দেশের জনগণ। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল সেই সম্ভবনা। ঠিক সময়ে উপযুক্ত সামরিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং অর্থনীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো মৌলিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হন তিনি। মূলত এ কারণেই জনসমর্থন হারাতে থাকে তার। শেষ রক্ষার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত রেখে বিদেশি ষড়যন্ত্র, হুমকিমূলক চিঠির কথাও বলেছিলেন। তবে পরিণাম এড়াতে পারেননি তিনি। তার ক্ষমতায় আসায় ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর কারসাজি ছিল বলেও সন্দেহ রয়েছে। এই সন্দেহের কারণেই হয়তো পদচুত্য হওয়ার আগে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। অবশেষে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচুত্য করে ইমরান খানকে।
যদিও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ অনাস্থা ভোট ঠেকানোর অনেক চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে হার মানতে বাধ্য হন তারা। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সংবিধান ও গণতন্ত্রের বিজয় বলে অভিহিত করেছেন। ইমরান খানের পতনের পরে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই এবং বিরোধীদলীয় নেতা শেহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বলা বাহুল্য, শরিফ পরিবার আরও একবার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে পাকিস্তানের পুরনো রাজনৈতিক রাজবংশের আধিপত্য শক্তিশালী হয়ে উঠলো আবারও। ইতোমধ্যেই বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে আবার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের অন্যান্য সংসদ সদস্যরাও পদত্যাগ করছেন। ফলে সংসদে বিরোধীদল বিহীন এক অগণতান্ত্রিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান পাকিস্তানে। একদিকে যেখানে দেশটির সুশীল সমাজ বলছে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে, সেখানে অন্যদিকে ইমরানভক্ত জনগণের একাংশ তার পক্ষে আন্দোলন করছেন। সুতরাং বলা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুব দ্রুতই আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই; নেই গণতন্ত্রের বিকাশ হওয়ার খুব বেশি আশাও।
গণতেন্ত্রর জন্য অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং জনগণের গণতেন্ত্রর প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি হওয়া, একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেনো, তাকে সচেতনতার সঙ্গে সুশীল সমাজের সাহায্যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তান কখনই এই অভিশাপ কাটিয়ে প্রহসনের গণতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]