ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান পাইপলাইন বন্ধ করল রাশিয়া
রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগর দিয়ে যাওয়া জার্মানিতে রুশ গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম বন্ধ করে দেয়া হলো।
অপারেটর নর্ড স্ট্রিম এজি বলেছে, বার্ষিক সারাই/মেরামত কাজের জন্য সোমবার থেকে ১০ দিন পাইপলাইনটি বন্ধ থাকবে। এ সময় এই পাইপলাইন দিয়ে সব ধরনের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
নর্ড স্ট্রিম এজি জানিয়েছে, এই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকার ব্যাপারে আগেই সব অংশীদাররা একমত হয়েছে।
গত মাসেই রাশিয়ান জ্বালানি জায়ান্ট পরিচালন চ্যালেঞ্জের কারণে জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিমের মাধ্যমে জার্মানিতে গ্যাসের চালান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। কানাডা থেকে একটি সারাইকৃত টারবাইন ফিরিয়ে দিতে বিলম্বিত হওয়ার ফলে এই চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।
তবে জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেবেক নর্ড স্ট্রিম এজির এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, রাশিয়া 'রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে'র ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নর্ড স্ট্রিমের মেরামতের কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে ইউক্রেন বা পোল্যান্ড দিয়ে সরবরাহ বাড়িয়ে তা পুষিয়ে দিচ্ছিল রাশিয়া। কিন্তু চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এখন তা-ও বন্ধ রয়েছে।
এই সারাইকালে ক্রেমলিন গ্যাস সরবরাহের পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জার্মানি।
হেবেক গত জুনে বলেছেন, 'প্যাটার্ন দেখে যা বুঝছি, তাতে যদি ছোটখাটো কারিগরি ত্রুটি বের করে ওরা বলে "আমরা এখন আর এটি [নর্ড স্ট্রিম] চালু করতে পাচ্রি না", তাহলে খুব একটা অবাক হব না।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানির ৪০ শতাংশ রাশিয়ার পাইপলাইনের মাধ্যমে এসে থাকে। ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর ইইউ যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে।
জার্মানির জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রধান ক্লাউস মুলার সিএনবিসিকে বলেন, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মেরামত কাজ শেষ হয়ে গেলেও রাশিয়া ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রাখতে পারে।
"বার্ষিক সারাই প্রক্রিয়া শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই পাইপলাইন দিয়ে আর কোনো গ্যাস আসবে না। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু হবে কি না আমরা তাও জানি না। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না," বলেন মুলার।
ইউরেশিয়া গ্রুপের রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষকরাও একই কথা বলেন।
পুতিনের চালে যদি সারাই কাজের পরেও গ্যাস সরবরাহ ফিরে না আসে তবে গ্রীষ্মের শেষের দিকে মজুদ পরিপূর্ণ করার যে পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়িত হবে না বলে জানান ইউরেশিয়া গ্রুপের শক্তি, জলবায়ু ও সম্পদ বিষয়ক পরিচালক হেনিং গ্লয়েস্টেইন।
নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের বেশিরভাগ অংশই রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রমের মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
অর্থনৈতিক ধাক্কা
জার্মানি তিন-স্তরের জরুরি গ্যাস পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে চলে গেছে। সরকারের জ্বালানি ব্যবহার রেশনিংয়ের ঠিক আগের পর্যায়ে আছে দেশটি।
রাশিয়ার গ্যাস প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে মন্দা দেখা দিতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছে দেশটি। আর রুশ গ্যাস বন্ধ হলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ১৯৫ বিলিয়ন ডলার লোকসান দিতে পারে দেশটির অর্থনীতি।
রুশ গ্যাস আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে জার্মানির শ্রমশক্তিতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। প্রায় ৫৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়। জার্মানির গ্যাসপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপে গ্যাসের দাম দীর্ঘদিন চড়াই থাকবে। ইতিমধ্যেই মহাদেশটিতে গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে।
গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে পাইকারি পর্যায়ে ডাচ গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০০ শতাংশের বেশি।
ডাচ জ্বালানিমন্ত্রী রব জেটেন বলেছেন, 'নর্ড স্ট্রিম বন্ধ করে দিলে বা জার্মানিতে রুশ গ্যাস আমদানি একদম বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়বে গোটা উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে।'
বৃহস্পতিবার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য ডাচ গ্রোনিনজেন-এর গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ালে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও বাড়বে।
আবার নর্ড স্ট্রিম ১ দিয়ে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করলে পশ্চিম ইউরোপের মতো রাশিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গত জুনে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, বাজেট পরিকল্পনায় যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, তেল ও গ্যাস বিক্রি করে তার চেয়ে ৩৯৩ বিলিয়ন রুবল (৬.৪ বিলিয়ন ডলার) বেশি আয়ের আশা করছে তারা।
জুলাইয়ে বাজেট পরিকল্পনার প্রাক্কলনের চেয়ে ২৫৯ বিলিয়ন রুবল বেশি আয়ের আশা করছে রুশ অর্থ মন্ত্রণালয়।
- সূত্র: সিএনবিসি, রয়টার্স ও আরটি