ভারতে চাল উৎপাদনের ঘাটতি খাদ্য সংকটের নতুন কারণ হতে পারে
বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক ভারত। কিন্তু, ধানের চারা রোপণের মৌসুমে দেশটির অনেক অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। তাই এবছরে শস্যটির আবাদি জমির পরিমাণ তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে। এই ঘটনা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের জন্য পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন পরিত্রাহী দশা সৃষ্টি করেছে- খাদ্যের চড়া মূল্য আর লাগামহীন মূল্যস্ফীতি। তারমধ্যেই ভারতে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার এই হুমকি দেখা দিল। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশসহ দেশটির ধান উৎপাদক- প্রধান কিছু অঞ্চলে ধানের আবাদি জমি ১৩ শতাংশ কমেছে। এসব এলাকায় বৃষ্টিপাতের অভাবই কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে। উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ থেকেই দেশটির ২৫ শতাংশ চালের যোগান আসে।
দেশটির কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, চাল উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভারতের মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার যুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে পড়বে; ফলে দেওয়া হতে পারে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা। চাল বিশ্বের শত শত কোটি জনতার প্রধান খাদ্য হওয়ায়–এই নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
বৈশ্বিক চাল বাণিজ্যে ৪০ শতাংশ সরবরাহ যোগায় ভারত। ইতঃপূর্বে স্থানীয় বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম ও চিনি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় নয়াদিল্লি।
এরমধ্যে দেশটির বাজারে চালের মূল্যেও উত্থান ঘটেছে। এমনকী গত দুই সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও ছত্তিশগড়ের মতো প্রধান উৎপাদক অঞ্চলে কয়েক ধরনের চালের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অনাবৃষ্টির পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশের বর্ধিত আমদানি চাহিদা এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে জানান চাল রপ্তানিকারক সংস্থা– স্পঞ্জ এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক মুকেশ জৈন।
তিনি মনে করছেন, 'ফ্রি অন বোর্ড' বাণিজ্য ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রতিটন চালের দাম ৩৬৫ ডলার হলেও, সেপ্টেম্বর নাগাদ তা ৪০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ চাল উৎপাদন ও ভোগ দুইই হয় এশিয়ায়; ফলে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এর পর্যাপ্ত সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে বিশ্ববাজারে যখন গম ও ভুট্টার দর বিপুল হারে বাড়ছিল–তখন যথেষ্ট উৎপাদন এবং বিদ্যমান মজুদের কারণে চালের দাম খুব একটা বাড়েনি। ফলে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মারাত্মক হয়ে ওঠার ঝুঁকি এড়ানো গেছে অনেকটাই। সেই শস্য নিয়েই এখন দুঃসংবাদ দুয়ারে কড়া নাড়ছে।
ভারতে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপর এখন চাল উৎপাদনসহ বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার দিকটি নির্ভর করছে। কিছু কৃষি বিজ্ঞানী অবশ্য আশা করছেন, এই মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি, ধান রোপণের সময় এখনও আছে। সময়মতো রোপণ অব্যাহত থাকলে, ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে। এই আগস্ট ও আসছে সেপ্টেম্বরে দেশটিতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ফলন বাড়াতে পারে।
কৃষকরা অবশ্য ততোটা আশাবাদী নন। উত্তর প্রদেশের একজন ধানচাষী রাজেশ কুমার বলেন, জুন ও জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের অভাবে তিনি তার মোট সাত একর জমির মধ্যে মাত্র অর্ধেক জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছেন। 'পরিস্থিতি সত্যিই অনিশ্চিত' মন্তব্য করেন ৫৪ বছরের এ অভিজ্ঞ কৃষক।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিমাংশু জানান, আগামী ফসল সংগ্রহের মৌসুমের অনিশ্চয়তার চাপ- এরমধ্যেই দেশে চালের বাজারে পড়তে শুরু করেছে।
তিনি বলেন, 'মধ্য জুলাই পেরিয়ে যাওয়ার পর ধানের চারা রোপণ খুব কমই করা হয়। তাই ফলন পুনরুদ্ধার খুব সম্ভবত হবে না'। উৎপাদনে এই ঘাটতি মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াবে বলেও যোগ করেন হিমাংশু।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) চলতি বছরের জন্য ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। কিন্তু ভোক্তা মূল্যস্ফীতি এরমধ্যেই সেই সহনসীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে এটি নিয়ন্ত্রণে তীব্রভাবে সুদহার বাড়াতে হয় আরবিআইকে। ডলারের বিপরীতেও বিনিময় দর হারাচ্ছে ভারতীয় রুপি, ফলে চলতি সপ্তাহে সুদহার আবারো বাড়াতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি।
নোমুরা হোল্ডিং ইনকর্পোরেশনের অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা বলেন, বৃষ্টিপাতের ভৌগলিক অসমতা যদি চলতেই থাকে–তাহলে ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে- ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি।
ভারতীয় চালের শীর্ষ ক্রেতা যেসব দেশ
প্রায় ১০০টির বেশি দেশে চাল রপ্তানি করে ভারত। তবে সবচেয়ে বড় গ্রাহক হলো- বাংলাদেশ, নেপাল ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।
চাল ছাড়া সার্বিকভাবে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবশ্য একটি সুসংবাদ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে গমের বাম্পার ফলন হয়েছে, যা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিশ্ববাজারে আসছে। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া ও তুরস্কের সাথে চুক্তি করে প্রথমবারের মতো জাহাজে করে খাদ্যশস্যের একটি চালান পাঠাতে পেরেছে ইউক্রেনও।
এদিকে কয়েকটি রাজ্যে ধানের উৎপাদন যেহেতু কমতে চলেছে, তাই সরকারকে ইথানল উৎপাদনে চালের ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করেছেন ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সিরাজ হোসেন।
এর আগে জ্বালানি আমদানির ব্যয় কমাতে উদ্বৃত্ত চিনি ও চাল ব্যবহার করে ইথানল জ্বালানি উৎপাদনের একটি নীতি গ্রহণ করেছিল ভারতীয় সরকার। এটি এখন পর্যালোচনা করা দরকার বলেই মনে করেন তিনি।
অবশ্য শুধু ভারত নয়, ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই দুনিয়াজুড়ে 'খাদ্য বনাম জ্বালানি' কোনটিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত সে বিতর্ক চলছে। বায়োফুয়েল উৎপাদন ঘিরে এই বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
সিরাজ বলেন, 'এই মুহূর্তে কতোটা উৎপাদন কমতে চলেছে, তার প্রাক্কলন করাটা কঠিন। তবে চালের যে বর্তমান বাজার দর–তা আমলে নিয়ে বলতে হয়–এটিকে ইথানল উৎপাদনে ব্যবহার করাটা আর ন্যায্য হবে না'।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ