মিখাইল গর্ভাচেভ: কেন দেশের বাইরে দারুণ প্রশংসিত আর সোভিয়েতপন্থীদের কাছে নিন্দিত?
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েতের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ দু'রকম প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেছেন। ওয়াশিংটন, প্যারিস বা লন্ডনে তার জয়জয়কার, অন্যদিকে নিজ দেশের বেশ কিছু সংখ্যক রাশিয়ান তাকে কখনো ক্ষমা করেনি তার সংস্কারপন্থী কাজের জন্য।
তার গ্লাসনস্ত নীতি রাশিয়ানদের অচিন্তনীয় স্বাধীনতা দিয়েছিল। রাশিয়ান শব্দ গ্লাসনস্তের অর্থ উন্মুক্ততা বা স্বচ্ছতা। ১৯৮০'র দশকে শেষদিকে গ্লাসনস্ত নীতি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তবে এর পরবর্তী সময়ে দেশটিতে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেভাবে নেমে এসেছিল সে কারণেই বীতশ্রদ্ধভাবে তাকে স্মরণ করেন অনেক রাশিয়ান।
অন্যদিকে, সোভিয়েত স্বপ্নে বুদ রাশিয়ানরা আবার তাকে সাম্রাজ্য ধ্বংসকারী হিসাবে দেখেন। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া সোভিয়েত ব্লকজুড়ে স্বাধীনতাকামীদের সাফল্যের জন্য গর্বাচেভের নীতিকে দায়ী করেন তারা।
২০২১ সালে এক পোলে ৭০ শতাংশের বেশি রাশিয়ান বলেছিল, গর্ভাচেভের শাসনামলে রাশিয়া নেতিবাচক পথে এগিয়েছে। এর আগে সরকারি এক জনমত ভোটে গত শতাব্দীর সবচেয়ে কম জনপ্রিয় রাশিয়ান নেতার আখ্যা পান।
নিজের সমালোচনা আর দেশের বিরাট অংশের জনগণের ভাবনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের অনেকে অন্য ধরনের নেতৃত্ব চাইছে।
তিনি একবার বলেছিলেন, "একজন জারকে অবশ্যই জারের মতো আচরণ করতে হবে, আর আমি জানি না কীভাবে তা করতে হয়"।
ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তার সম্পর্ক সবসময়ই জটিল ছিল। ২০১৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পুতিনের তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হবার লড়াইয়ে দাঁড়াবার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন গর্ভাচেভ, পুতিনের নীতিকে 'উন্নয়ন পরিপন্থী' আখ্যা দেন তিনি।
প্রতুত্যরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে 'শতাব্দীসেরা ভূ-রাজনৈতিক দুর্যোগ' আখ্যা দেন পুতিন।
মঙ্গলবার রাতে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, গর্ভাচেভের মৃত্যুতে পুতিন গভীরভাবে দুঃখিত। তার পরিবারের প্রতি শোকবার্তাও পাঠানো হয়।
তবে, রাশিয়ার উদারপন্থীদের মধ্যে আবার গর্ভাচেভ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, দেশটিতে বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়া উদারপন্থীদের অনেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে রাশিয়া ছেড়েছে।
প্রবীণ রাশিয়ান সাংবাদিক মিখাইল ফিশম্যান লিখেছেন, "গর্ভাচেভ একজন স্মৃতিবিজড়িত নেতা… রাশিয়ায় ৮০ ও ৯০'র দশকের মতো স্বাধীনতা আর কখনো ছিল না। এটাই তার যোগ্যতা"।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কভারেজের জন্য বন্ধ করে দেওয়া একো মস্কভি রেডিও স্টেশনের সাবেক প্রধান আলেক্সি ভেনেডিক্টভ বলেছেন, "আমরা সবাই এতিম হয়ে গেছি, কিন্তু এখনও সবাই এটি বুঝতে পারেনি"।
রাশিয়ায় স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের যাত্রায়ও গর্ভাচেভের ভূমিকা অনেক, ১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের পাওয়া অর্থ নোভায়া গ্যাজেটা নামের স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় দিয়ে দিয়েছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখায় ১৯৯০ সালে শান্তিতে নোবেল পান তিনি। এই পত্রিকা পরবর্তী সময়ে দেশটির অন্যতম প্রধান স্বাধীন সংবাদপত্র হয়ে ওঠে, রাশিয়ার অনেক অন্ধকার অধ্যায়ও তুলে ধরে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর এই পত্রিকাটির কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গর্ভাচেভকে অনেক কাছ থেকে চিনেছিলেন তার জীবনিকার উইলিয়াম টবম্যান। ২০১৭ সালে তিনি লিখেছিলেন, রাশিয়াকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, এমন বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না দেশটির ইতিহাসে, এটিই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
গর্ভাচেভকে শেষদিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন উদারবাদী অর্থনীতিবিদ রুসলান গ্রিনবার্গ। পুরনো বন্ধুকে দেখে আসার পর তিনি বলেছিলেন, "তিনি আমাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন- কিন্তু আমরা জানতাম না এ স্বাধীনতা নিয়ে কী করতে হয়"।
১৯৩১ সালের ২ মার্চ সোভিয়েত রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রিভলনয় গ্রামে এক রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় কৃষক পরিবারে জন্ম তার।
তৎকালীন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের কৃষি যৌথীকরণের অংশ ছিল তার গ্রামও। সে সময় এ পদক্ষেপের কারণে লাখো কৃষক দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
১৯৩০'র দশকে গর্ভাচেভের বাবা-দাদা দুজনকেই গুলাগে পাঠানো হয়, ১৯৩২-৩৩ এর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তার পরিবারও।
গর্ভাচেভের জীবনিকার উইলিয়াম টবম্যান বলেছিলেন, জীবনের প্রাথমিক দিকের এসব অভিজ্ঞতা তার মনে ছাপ রাখে। হাইস্কুলে থাকতেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি।
রাজনীতিতে এসে সোভিয়েত কৃষিখাতকে আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করেন তিনি।
তার পেরেস্ত্রইকা ও গ্লাসনস্ত- এই ২ নীতি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সেন্সরশিপ দূর করে স্বচ্ছতা আনার উদ্দেশ্যে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট বাস্তবায়ন করে জনগণের ক্ষমতা নিশ্চিতেও ভূমিকা রাখেন তিনি।
অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করতে বেশ কিছু সংস্কার নীতি প্রণয়ন করেন তিনি। তার সংস্কার কাজ অবশ্য তার দলের নেতাদেরই চোখ এড়িয়ে গেছিল অনেক সময়।
তার নতুন সংস্কারের রাষ্ট্র পদ্ধতি ধাক্কা খায় ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, চেরনোবিল বিস্ফোরণের পর। এর প্রায় ২০ বছর পর তিনি বলেছিলেন, সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের কারণ ছিল চেরনোবিল, পেরেস্ত্রোইকা নীতি নয়।
১৯৭৯ সালে রাশিয়ার আফগানিস্তান দখলের প্রতিবাদে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মস্কো অলিম্পিকসে খেলোয়াড় পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। ছয় বছরের মধ্যে গর্ভাচেভ আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ট্রুপস অপসারণ করেন, গালফ যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন আর বাগদাদের মধ্যে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা রাখেন।
তার শাসনামলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা ও অন্যান্য অনেক দেশ সফরে যান তিনি। মার্গারেট থ্যাচার একবার বিবিসির সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি মি. গর্ভাচেভকে পছন্দ করি। আমি মনে করি একসাথে কাজ করতে পারব আমরা"।
অনেকেই শান্তিপূর্ণভাবে পূর্বাঞ্চলীয় ব্লকের বিলুপ্তি মোকাবিলা করায় তার প্রশংসা করেন, আবার প্রতিবেশি দেশে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিউনিস্ট সিস্টেম বিলুপ্তির জন্য অনেকের সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি।
তার অস্ত্র চুক্তির জন্য প্যারিস চার্টারের পথ সুগম হয়, এরফলে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয় ও পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বিরোধ অবসান হয়।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে গর্ভাচেভের পূর্ব জার্মানি সফরের কিছুদিন পরেই বার্লিন দেয়ালের পতন হয়। গর্ভাচেভ নিজে বারবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কখনোই তার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তার নেতৃত্বে এমন এক চেইন রিএকশন শুরু হয় যা পৃথিবীকে বদলে দেয় চিরতরে।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষে 'গর্ভাচেভ ফাউন্ডেশন' গঠন করেন তিনি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে সবসময়ই কথা বলা জারি রেখেছিলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য মস্কো টাইমস