চাল রপ্তানি বন্ধ করা ভারত ও বাকি বিশ্ব কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না
কয়েক মাস আগে তাপপ্রবাহে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় নয়াদিল্লি। ভারত অন্যতম উৎপাদক হওয়ায় বিশ্ববাজারে শোরগোল ফেলে এ ঘটনা। গমের দামে দেখা দেয় আরও উল্লম্ফন।
ভারত নিজেও গমের বৃহৎ ভোক্তা, সে তুলনায় ততো বড় রপ্তানিকারক নয়। তবুও এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকায়। তার চেয়েও বড় সংকট অবশ্য সামনে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার চাল রপ্তানিও বন্ধ করে দিতে পারে নয়াদিল্লি–অথচ ভারত বিশ্ববাজারে চালের বৃহত্তম রপ্তানিকারক।
ভারত যখন গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন বৈশ্বিক সরবরাহে কোনো সমস্যা না থাকায় চালের বাজারদর ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। দুর্বল রুপিও রপ্তানি মূল্য কম থাকার পেছনে অবদান রাখে। বর্তমান পরিস্থিতি তার উল্টোই। চলতি বছরে ধান গাছে 'স্টানিং ডিজিজ' নামক রোগ ছড়িয়েছে ভারতে। আরও অশনি দশার জন্ম দিয়েছে, উত্তর ও পূর্ব ভারতের প্রধান চাল উৎপাদক তিনটি রাজ্যে স্বল্প ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত।
চালের পড়তির মুখে থাকা সরবরাহ ও স্থানীয় মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারতীয় কর্মকর্তারা চাল রপ্তানি সীমিত করতে পারেন– এমন আলোচনাও হচ্ছে। কিন্তু, নয়াদিল্লি যেভাবে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে পাইকারে হারে নিষেধাজ্ঞা দেয় তা এবার দেয়া হবে– বিশ্ববাসী ও ভারতীয় কৃষক উভয়ের স্বার্থের জন্যই চরম ভুল সিদ্ধান্ত।
সর্বশেষ ২০০৭ ও ২০০৮ সালে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে ভারত। এই সিদ্ধান্ত এক বছরব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকট তৈরি করে। আবারো একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও নিস্ফল।
দায়িত্বজ্ঞানহীন কারণ, বৈশ্বিক পর্যায়ে চালের উচ্চমূল্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর আঘাত হানবে– ইতোমধ্যেই যারা ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলার ভুক্তভোগী। এই যুদ্ধ দুনিয়াজুড়ে ঊর্ধগামী করেছে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম। আর এমন সময়েই তা হয়েছে, যখন কমছে তাদের আর্থিক সক্ষমতা।
ভারত উন্নয়নশীল বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চায়। তাই যাদের পক্ষ হয়ে কথা বলার দাবি করে, জেনেশুনে তাদের ক্ষতি করতে পারে না।
তাছাড়া, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় ভারতের নিজস্ব মূল্যস্ফীতি যেমন কমবে না, তেমনি নিশ্চিত হবে না জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা। আগস্ট পর্যন্ত ভারত সরকারের গুদামগুলোয় মজুত রয়েছে ২ কোটি ৮০ লাখ মে. টন চাল (যা বাধ্যতামূলক ১ কোটি ১০ লাখ মে. টন বাফার মজুতের চেয়ে অনেকটাই বেশি)। তাই অচিরেই ভারতে চাল সংকট দেখা দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
একইসময়ে, কৃষি অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটি ও রিতিকা জুনেজা তাদের বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন, ভারতে মূল্যস্ফীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো– জ্বালানি ও শাকসবজির বাড়তি দাম। গত মাসের ভোক্তা পর্যায়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে মাত্র ২ শতাংশ ভূমিকা ছিল চালের।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শুধু দরিদ্র দেশের জন্যই দুর্দশার নয়; ভারতীয় কৃষকদের জন্যও তা দুঃসংবাদ– যারা বিদেশে বাড়তি দামের সুযোগ বঞ্চিত হন।
প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষার নাম করে, বৈশ্বিক অনেক সম্মেলনে নিজস্ব কৃষি বাণিজ্য নীতির পক্ষে যুক্তি দেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। এই যুক্তিতে তারা ভর্তুকি কমানোর মতো আন্তর্জাতিক চাপ পাশ কাটিয়ে যান। কিন্তু, বাস্তবতা বলছে, তারা শহুরে জনগোষ্ঠীর স্বার্থ নিয়েই বেশি চিন্তিত, কৃষকদের মুনাফা কৃষি বাণিজ্য নীতির অগ্রাধিকার নয়।
বিশ্ববাজারে দামে ধস নামলে লোকসান ওঠাতে হয় ভারতীয় কৃষকদের। আবার সরকার রপ্তানি বন্ধ রাখলে, এককভাবে স্থানীয় বাজারের ওপর বাজি ধরার ঝুঁকিও তাদেরই নিতে হয়, রপ্তানি বাজারের বাড়তি দামও তারা পান না।
গম রপ্তানি নিষিদ্ধের পর ভারত বিশ্বস্তরে যে সমালোচনার মুখে পড়ে, তার উদ্দেশ্যই ছিল দেশটি যেন চালের ক্ষেত্রে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে। এই কৌশল কিছুটা কাজে দিয়েছে মনে হচ্ছে। যেমন ভারত সরকার এখন '১০০ শতাংশ ভাঙ্গা চাল' রপ্তানি সীমিত করছে, নিম্ন মানের এ ধরনের চাল মূলত পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আর বেশি রপ্তানি হতো চীনে।
এই পদক্ষেপে চীনের শুকর খামারিদের লাভের মার্জিন কমবে নিঃসন্দেহে। ইতোমধ্যেই, মুনাফা কমায় সেখানে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। কমেছে দেশটির শুকর পালের সংখ্যাও। বাজারে মাংসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ এবং তা চীনে ভোক্তা মূল্যস্ফীতিকে দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে গেছে। এত বড় আঘাতকে নগণ্য বলার উপায় নেই।
কিন্তু, ভারত সম্পূর্ণভাবে সব রকমের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বিশ্ববাজারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত–তার তুলনায় এটা কিছুই নয়। কারণ, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক– ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড একই পদক্ষেপ নিতে পারে। তাই আশা করা যায়, ভারত সরকার তাদের দায়িত্ববোধকে বর্তমান সংকট কেটে যাওয়ার আগপর্যন্ত ধরে রাখবে।
ভারতের কৃষি খাতের বর্তমান ধান উৎপাদন সংকটের আসল কার্যকারণের দিকেও তাদের আরও মনোযোগ দেয়া উচিত। বাস্তবতা হলো- ভারত বিশ্বের 'ভাতের থালা' হলেও, চাষবাস পদ্ধতি বিস্ময়করভাবে অনুৎপাদনশীল।
ভারতে ধানের আবাদ আজো মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বৃষ্টিপাতের অভাবে যে তিনটি রাজ্য– পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশে উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে– সেখানকার সেচ ব্যবস্থাও পিছিয়ে রয়েছে। ফলে এসব রাজ্যের কৃষকরা সব বছর সমান ফসল ফলাতে পারেন না। আবহাওয়ার করুণার ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের।
সেচ ও আধুনিক কৃষি পদ্ধতির অভাবে হেক্টরপ্রতি ফলনও যথেষ্ট কম হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, ২০২০ সালে ভারতে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন হয়েছে মাত্র চার টন। ভিয়েতনামে যা প্রায় ৬ টন, এমনকি প্রতিবেশী বাংলাদেশেও তা ৪.৮ টন বা এশিয়া মহাদেশের গড়ের কাছাকাছি।
তাই বিশ্ব ও নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত যে প্রকৃত বড় পদক্ষেপ নিতে পারে– তা হলো ধানের ফলন বাড়ানোর কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ। উল্টো রথে চেপে, বন্ধু দেশের নাগরিক ও কৃষকদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে না তুলে, সেখানেই ভারত সরকারের অর্থ ও সময় ব্যয় করা উচিত।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের কলামিস্ট। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।