তিন বছর আগেও ছিলেন কারাগারে, এখন তিনি ব্রাজিলের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে
তিন বছর আগেও কারাগারে অনিশ্চিত দিন কাটছিল লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভার।
২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। 'দুর্নীতি'র দায়ে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল তার। তখনই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিল সবাই।
কিন্তু সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় রিও ডি জেনিরোতে শ্রমজীবী শ্রেণির এক সমাবেশে সেই লুলা ডি সিলভার নাম নিয়েই স্লোগান তোলে হাজার হাজার মানুষ।
সেউ সমাবেশে লুলা ডি সিলভা বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, 'মানুষ শখে গরিব হয় না। আমরা কাজ করতে চাই, আমরা ভালো খেতে চাই, আমরা চাই আমাদের সন্তানরা যেন ভালো কাপড়-জুতো পরে আর দিনে তিন বেলা খেতে পায়।'
এই নেতা যখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ দেন, তখন অনেকেরই মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে।
ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া এক রাজনীতিবিদের এমন প্রত্যাবর্তন হবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
ব্রাজিলের মানুষ তাকে ভালোবেসে ডাকে লুলা নামে। সাম্প্রতিকতম জরিপে দেখা গেছে, দেশটির আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিপক্ষ অতি-কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছেন।
লুলা ডি সিলভার জন্ম উত্তরপূর্ব ব্রাজিলের এক দরিদ্র পরিবারে। ১২ বছর বয়সে তাকে স্কুল ছাড়তে হয় ভাইবোন ও মাকে সাহায্য করবার জন্য। কাজ নেন একটি অটো যন্ত্রাংশের কারখানায়। কয়েক বছর পর কারখানায় এক দুর্ঘটনায় তিনি কড়ে আঙুল হারান।
তরুণ বয়সেই লুলা জড়ান রাজনীতিতে। তার নেতৃত্বে ইস্পাত শ্রমিকরা অনেকগুলো ধর্মঘট করেন। ওসব আন্দোলনের ফলে ১৯৮৫ সালে ব্রাজিলে স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়।
এরপর লুলা পরপর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েন—১৯৮৯, ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালে। তিনবারই পরাজিত হন।
অবশেষে ২০০২ সালের নির্বাচনে জয়ের দেখা পান লুলা। সেজন্য অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করতেন, এমন কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা করতে হয় তাকে।
লাতিন আমেরিকায় বাম রাজনীতির তখন সুসময় চলছে। গোলাপি ঢেউয়ে আর্জেন্টিনা থেকে ইকুয়েডর পর্যন্ত অনেক দেশে বাম সরকার ক্ষমতায় আসে। এ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ।
তবে বামপন্থী হলেও লুলা অনেকটাই বাস্তববাদী। ক্ষমতায় আসার পর তিনি একজন ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারকে ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংক-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। ওই সময়ে অন্যান্য বামপন্থী সরকারগুলো যখন আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে যাচ্ছিল, ব্রাজিল তখন সময়ের আগে আগেই ঋণ শোধ করে দিচ্ছিল।
ব্রাজিলের নিম্নবিত্তদের জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভালো দিন এনেছিলেন লুলা। তার শাসনামলে স্বল্প আয়ের যেসব পরিবারের—যাদের মাসিক আয় ৩৫ ডলারের কম—সন্তানরা স্কুলে যেত ও অপরাধমুক্ত থাকত, ওসব পরিবারকে সন্তানপিছু ৭০ ডলার ভাতা দেওয়া হতো। এই প্রকল্পের ফলে ব্রাজিলে কমে যায় শিশুদের অপরাধে জড়িত হওয়ার হার।
এই প্রকল্পের সুবিধা পায় ৫ কোটি ব্রাজিলিয়ান। অথচ দারিদ্র্য বিমোচনে এই বড় সাফল্য অর্জন করতে খরচ হয়েছিল ব্রাজিলের জিডিপির মাত্র ০.৫ শতাংশ।
লুলার আমলেই ব্রাজিলে কর্মীদের সর্বনিম্ন মজুরি ১০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০০ ডলার করা হয়। এরকম পরিবর্তন আসে শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি খাতেও।
লুলা ক্ষমতায় থাকার সময় ব্রাজিলের ২ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসে। ওই সময় আফ্রো-ব্রাজিলিয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হারও তিনগুণ বেড়ে যায়।
নানা কর্মসূচি নিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন লুলা। ২০১১ সালে যখন ক্ষমতা ছাড়েন, তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল ৯০ শতাংশের বেশি।
কিন্তু ক্ষমতা ছাড়ার পর তার বিপক্ষে ক্রমাগত 'দুর্নীতি'র অভিযোগ তুলতে শুরু করে কিছু গোষ্ঠী। 'অপারেশন কারওয়াশ' পরিচালিত করে ২০১৭ সালে 'দুর্নীতি'র দায়ে লুলাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 'অপারেশন কারওয়াশ'-এর অন্যতম কুশীলব, বিচারক সের্গিও মরো পরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো-র আইনমন্ত্রী হন।
ফৌজদারি আইনে সাজা হওয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি লুলা। তবে ২০২১ সালের মার্চে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে মুক্তি পান লুলা ডি সিলভা। যদিও তার আগে তাকে ১৮ মাস জেল খাটতে হয়।
তবে জেল খেটে বেরোনোর পরও জনপ্রিয়তায় বলসোনারোর চেয়ে বেশ এগিয়ে লুলা। জরিপে আগামী ২ অক্টোবর নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ভোটে লুলা ডি সিলভার পক্ষে রয়েছে ৪৬ শতাংশ সমর্থন; যেখানে বলসোনারোর পক্ষে রয়েছে ৩৩ শতাংশ। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও লুলার পক্ষে সমর্থন ছিল ৪৪ শতাংশ, বলসোনারোর পক্ষে ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলসোনারোর বিপরীতে লুলার জনসমর্থন বেড়েই চলেছে।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞেরই মত, শাসনক্ষমতায় এবার লুলা ডি সিলভার বসার সম্ভাবনাই বেশি। প্রবীণ এই নেতা আবারও ক্ষমতায় এলে তা ব্রাজিলের রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তনের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
- সূত্র: এলএ টাইমস, রয়টার্স, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট