অর্থের চেয়ে যেখানে ব্যবহৃত গাড়ির স্থায়িত্ব মূল্য অনেক বেশি!
পাকিস্তানের গাড়ির বাজার একটু অদ্ভুত। এখানে আপনি একটি নতুন গাড়ি কিনে কয়েক বছর ব্যবহার করলে এর দাম কমবে না। বরং আরও উচ্চমূল্যে গাড়িটি বিক্রি করতে পারবেন।
ফাউন্ডেশন সিকিউরিটিজ প্রাইভেট-এর বিক্রয় বিভাগের প্রধান মুহম্মদ রামীজ ২০১৯ সালে সুজুকি মোটর কর্পোরেশন-এর আউটলেট থেকে একটি ব্র্যান্ড নিউ হ্যাচব্যাক গাড়ি কেনেন। করাচিতে তিন বছর ধরে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা চালানোর পরে রামীজ গাড়িটি মূল দামের ৬৫ শতাংশের বেশি দামে বিক্রি করে দেন।
পাঁচ বছর আগে ২০ লাখ রুপিতে কেনা একটি টয়োটা করোলা গাড়ি বর্তমান সেকেন্ড-হ্যান্ড বাজারে ৩২ লাখ রুপিতে বিক্রি করা সম্ভব। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের আগে গাড়িটির বিক্রয়মূল্য ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এমনটাই জানিয়েছে করাচিভিত্তিক অপ্টিমাস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি।
মুদ্রার দরপতন, সুরক্ষাবাদী বাজার এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি- এসব কারণে পাকিস্তানে গাড়ির মূল্য অনেক বেড়েছে, আর ব্যবহৃত গাড়ির বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা (অনেক সময় 'বিনিয়োগকারী'ও বলা হয়) প্রচুর পরিমাণে নতুন মোটরগাড়ি কিনে এক সময় উচ্চদামে বিক্রি করে দেন।
পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিক্স- এর তথ্যমতে গত পাঁচ বছর ধরে পাকিস্তানি ক্রেতারা ৯০ শতাংশ যানবাহন ক্রয়ে 'অতিরিক্ত মূল্য' (এটাকে স্থানীয়ভাবে 'নিজস্ব অর্থ'ও বলা হয়) পরিশোধ করে আসছেন, যার মোট মূল্য ১৭০ বিলিয়ন রুপি।
লাকি মোটর কর্পোরেশন-এর অটোমোটিভ বিভাগের প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ ফয়সাল বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের (মধ্যস্বত্ত্বভোগী) উদ্দেশ্য হলো স্বল্পমেয়াদে অর্থ উপার্জন করা। আমরা গ্লোবাল ম্যান্যুক্যাকচারারদের সাথে যখন কথা বলি, লোকেরা গাড়ি কেনার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে দেখে তারা অবাক হয়।'
তবে এর বিকল্প ব্যবস্থা আরও ব্যয়বহুল।
মার্চ মাসে সুবহান মহসিন আহমেদ ৫৩ লাখ রুপি দামের একটি ২০২২ হোন্ডা সিভিক অর্ডার করেন। তাকে বলা হয়েছিল তার গাড়িটি পেতে এক বছর লাগবে। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত গাড়িটির দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে এবং আরও বাড়বে বলে অনুমান করা যায়।
পাকিস্তানে ক্রেতাদের গাড়ি বুক করার সময়ে দামের একটি অংশ পরিশোধ করে রাখতে হয়। বাকি অংশ দিতে হয় গাড়িটি পাওয়ার সময়। নতুন করাচির ইউপি মোড় বাজারে প্রতি রোববারের সন্ধ্যায় মিলিয়ন মিলিয়ন রুপির সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ির কেনাবেচা হয়। দুই হাজার গাড়ি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গ্রাউন্ড ফ্লোরে গাড়ি রাখার টিকেট নিতে বিক্রেতাদের ৩০০ রুপি গুণতে হয়। কোনো কোনো ব্যবসায়ী আশেপাশের রাস্তাতেও দরদামের কাজ চালান।
চলমান অর্থনৈতিক ওঠানাম চক্র (বুম-বাস্ট সাইকেল) পাকিস্তানকে ১৯৮০'র দশক থেকে এ সময় পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১৩টি ঋণ কর্মসূচি নিতে বাধ্য করেছে। আর এদিকে দেশটির মাথাপিছু আয় এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।
পাকিস্তান এশিয়ার মধ্যে দ্রুততম মুদ্রাস্ফীতির দেশগুলোর একটি। ২০০০ সাল থেকে পাকিস্তানি রুপির দাম প্রায় ৩০০ শতাংশ কমেছে।
২০০৪ সাল থেকে দেশটিতে মাত্র এক লাখ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ ২০ হাজারের মতো গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। জনগণের জীবনাযাত্রার স্থবির মানের কারণে দেশটির বাজার সীমিত পরিসরের। যার দরুন সেখানে বড় ফ্যক্টরি স্থাপন করা অসম্ভব।
এর বিকল্প হিসেবে কোম্পানিগুলো গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে। তারা প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রাংশ আমদানি করে সেগুলো স্থানীয়ভাবে জোড়া লাগিয়ে (অ্যাসেম্বল) গাড়ি তৈরি করে। অর্ডার পাওয়ার পরে চাহিদার পূর্বানুমান না করে অ্যাসেম্বলাররা গাড়ি তৈরিতে লেগে যায়। তাই, ক্রেতাদের গাড়ি ডেলিভারি পেতে হলে এক বছরের মতো অপেক্ষা করতে হয়।
সুইডেনভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার বাজার বিনিয়োগকারী টান্ড্রা ফন্ডার এবি-এর মতে, 'যেসব দেশে মুদ্রার মান নিয়মিত কমতে থাকে সেসব দেশে এই একই প্রবণতা দেখা যায়।' টান্ড্রা ফন্ডার-এর প্রধান বিনিয়োগকারী কর্মকর্তা ম্যাটিয়াস মার্টিনসন বলেন, 'অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল মুদ্রার দেশগুলোতে আমরা এই প্রবণতা দেখিনি। তবে পাকিস্তানের মোটরগাড়ি শিল্পের এই বৈশিষ্ট্য মিশরেও দেখা যায়।'
২০১৯ সালে লাকি গ্রুপ পাকিস্তানের বাজারে প্রথমবারের মতো কিয়া ব্র্যান্ডের গাড়ি আনে। তারা চেয়েছিল অন্য দশটা দেশের মতো ক্রেতারা নতুন গাড়ি কিনে চালাক। অর্থাৎ গাড়িগুলো যেন সেকেন্ড হ্যান্ড বাজারে না যায়। তাই লাকি গ্রুপের কর্মচারীরা শোরুমে গাড়ি দেখতে আসা ক্রেতাদের তালিকা করে ঘেঁটে দেখত তাদের মধ্যে কোনো বিনিয়োগকারী (মধ্যস্বত্ত্বভোগী) আছে কি-না।
করাচির ব্যবহৃত গাড়ির ডিলার স্যাম অটোমোবাইলস আমদানিকৃত আউডি ও পোর্শে'র মতো দামি গাড়ি বিক্রি করে থাকে। এর মালিক মুনীব গুলজার বলেন, 'গাড়িগুলো বিক্রি করার কোনো তাড়া নেই। কারণ গাড়িগুলো যতদিন শোরুমে থাকবে, তত এগুলোর দাম বাড়বে।'
সূত্র: ব্লুমবার্গ