তীব্র জ্বালানি সংকট: শীত সামনে রেখে কাঠ, ঘোড়ার নাদি মজুত করছে ইউরোপীয়রা
শীত সামনে চলমান গ্যাস সংকটের জেরে ইউরোপেজুড়ে চলছে কাঠের মজুদ, ঘোড়ার নাদি সংগ্রহ ও কাঠের চুলা (উড স্টোভ) কেনার হিড়িক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ তীব্র শীতে ঘর গরম রাখতে ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য সব উপকরণের মজুদ গড়তে শুরু করেছেন। রয়টার্স অবলম্বনে
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে রুশ জ্বালানি সরবরাহে বিপত্তি দেখা দিয়েছিল আগেই। এরমধ্যে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমে রহস্যজনক ছিদ্র দেখা দিলে জার্মানিতে গ্যাসের যোগান একেবারেই বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। এ ঘটনায় এখন গ্যাস সংকট নিয়ে চরম আতঙ্কে দিন পার করছেন ইউরোপীয়রা।
এ বারের শীতে ইউরোপজুড়ে ব্ল্যাকআউটেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শীত মোকাবেলায় তাই গ্যাসের বিকল্পের পিছনে হন্যে হয়ে ছুটছে ইউরোপবাসী।
শুক্রবার (৭ অক্টোবর) প্রাগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাশিয়ার গ্যাসের মূল্যসীমা বেধে দিতে অনেকেই দ্বিমত করেছেন, কারণ এই পদক্ষেপ নিলে ইউরোপে গ্যাসের যোগান আরও কমিয়ে বা একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে রাশিয়া।
ইউরোপীদের ঘর গরম রাখার ৭০ শতাংশই প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বিদ্যুৎ উৎসের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গ্যাসের যোগান ভয়াবহভাবে কমে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে কাঠের মজুদ করতে বাধ্য হচ্ছেন ইউরোপীয়রা। ফরচুন ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ ঘর গরম করতে কাঠ ব্যবহার করেন। তবে এখন এই পণ্যের চাহিদা আকাশছোঁয়া।
ফ্রান্সে কাঠের দাম মণপ্রতি দাঁড়িয়েছে ৬০০ ইউরো, যা গ্যাস সংকটের আগের দামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে কাঠ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে হাঙ্গেরি। আর ৬ মাসের জন্য জ্বালানি কাঠের দাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে রোমানিয়া।
এদিকে, পর্যাপ্ত সংখ্যাক কাঠের চুলা সরবরাহ করতে আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি, জ্বালানি সংকট জীবনযাত্রার ব্যয়কেও বাড়িয়ে তুলেছে। সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ইউরো-অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কে গিয়ে ঠেকেছে। অঞ্চলজুড়ে সাধারণ মানুষ এখন শীত মোকাবেলায় জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে চড়া দাম গুনছেন।
অনেকেই বলছেন, ইউরোপ আবারও পুরনো দিনে ফিরতে চলেছে, যখন কাঠের চুলা ব্যবহার করে পুরো বাড়ি গরম রাখা সম্ভব হতো না। সেই দিন আবারও ফিরে আসতে চলেছে ইউরোপীয়দের কপালে।
উড স্টোভের পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে টাইল স্টোভেরও। ইউরোপের শীত ঠেকাতে উড স্টোভের তুলনায় টাইল স্টোভ বেশি কার্যকর। সুইডিশ মুদ্রায় একটি টাইল স্টভের দাম পড়বে ৮৬ হাজার ক্রোনা। এই স্টোভ ২৪ ঘণ্টা ঘর গরম রাখে।
বছরখানেক আগের তুলনায় চারগুণ বেশি অর্ডার পড়েছে এ ধরনের স্টোভের জন্য। সরবরাহকরা বলছেন, নতুন ক্রেতাদের স্টোভ পেতে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আসন্ন শীতে ঘর উষ্ণ রাখতে যা যা প্রয়োজন তার ঠিকঠাক যোগাড় করাই এখন বেশিরভাগ ইউরোপীয়দের কাছে মূল উদ্বেগের বিষয়। এমনকি, শীত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের মানসিক চাপের কারণে স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সুইডেনের এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির এয়ার কোয়ালিটি ইউনিটের প্রধান রজার সেডিন বলেন, "আমরা উদ্বিগ্ন যে, লোকেরা হাতের কাছে যা পাবে, উষ্ণ থাকতে তাই পুড়িয়ে ফেলবে।"
ভেজা কাঠ ও পরিবেশ দূষণ করে এমন জিনিস পোড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, এমন অনেকেই আছেন, যারা কাঠ পোড়ানোর যথাযথ নিয়ম জানেন না। এর ফলে পরিবেশে উচ্চ মাত্রায় দূষণ দেখা দিতে পারে।
এদিকে, কিছু জায়গায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জ্বালানি কাঠ মজুদেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রান্সের একজন জ্বালানি কাঠ সরবরাহ ফরচুন ম্যাগাজিনকে বলেন, কিছু গ্রাহক তার কাছ থেকে দুই টন পরিমাণ কাঠ সংগ্রহ করেছে। অথচ একটি পরিবারের জন্য বছরে এক টনের কম জ্বলানি কাঠ প্রয়োজন হয়।
সাধারণত, শীতকাল শুরু হলে ইউরোপে জ্বালানি কাঠের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার ঘটনায় এ বছর জুন থেকেই কাঠের মজুদ করতে শুরু করেছেন ইউরোপীয়রা।
- সূত্র: ফরচুন ম্যাগাজিন