ইউক্রেনে সর্বাধুনিক সুখই-৫৭ লড়াকু জেট ব্যবহার রাশিয়ার,পশ্চিমাদের প্রচারণা ধোপে টিকল না!
ইউক্রেনে চলমান 'বিশেষ অভিযানে' সর্বাধুনিক সুখই-৫৭ জঙ্গিবিমান ব্যবহার নিয়ে নীরবতা ভেঙেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল সের্গেই সুরভিকিন গত মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) বিমানটি দিয়ে হামলা চালানোর কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। খবর ইউরেশিয়ান টাইমসের
সুরভিকিন বলেন, 'লড়াইয়ে পারদর্শীতার ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে সুখই-৫৭ বিমানের বহুমুখী ব্যবহার উপযোগীতার কথা বলতে চাই। পঞ্চম প্রজন্মের বিমানটি একইসাথে শত্রুর বিমান ও ভূমিতে থাকা লক্ষ্যবস্তু– ধবংসে সমান কার্যকর'।
অভিজ্ঞ এই রুশ জেনারেলের মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, ইউক্রেনে আকাশ থেকে আকাশ এবং আকাশ থেকে ভূমিতে– উভয় ধরনের ভূমিকায়– হামলা চলছে সুখই-৫৭ দিয়ে।
এর আগে গত জুনে রুশ গণমাধ্যম ইজভেতসিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইউক্রেনে বহুমুখী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা এবং কৌশলগত তথ্য নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া ৪টি সুখই-৫৭ বিমান ব্যবহার করেছে।
২০১৮ সালে সর্বপ্রথম সিরিয়া যুদ্ধে বিমানটি ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছিল রাশিয়া। সে বছরের জুলাইয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন দেশটির আইনপরিষদ- দ্যুমা'র বিমানশিল্প বিষয়ক পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞ ভ্লাদিমির গুতেনেভ।
তিনি বলেন, 'সিরিয়ার আকাশে আমাদের চারটি সুখই-৫৭ বিমানের ফর্মেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিশেষত, আমরা আমেরিকার এফ-২২ ও এফ-৩৫ পঞ্চম প্রজন্মের বিমানগুলির সক্ষমতা সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। আমাদের বিমান (রাডারের মাধ্যমে) একই এলাকায় অপারেশনে থাকা মার্কিন স্টিলথ বিমানগুলিকে শনাক্ত করে এই তথ্য সংগ্রহ করেছে'।
প্রতিরক্ষা খাত সম্পর্কে অবহিতরা জানেন, স্টিলথ বা রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার প্রযুক্তিতে বিশ্ব নেতৃত্ব আমেরিকারই (যুক্তরাষ্ট্রের) হাতে। তাই সেদেশেরই অন্তত চার যুগের গবেষণার ফসল দুটি সর্বাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের বিমানকে শনাক্ত করা সুখই-৫৭ এর বিরাট সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়।
পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের প্রস্তুত ও ব্যবহারকারী– আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া– কেউই তাদের পূর্ণ সক্ষমতা প্রকাশ করে না। নিরাপত্তার খাতিরেই গোপন রাখে কারিগরি অধিকাংশ বিষয়। তবু গত এক দশকে এসব বিমান সম্পর্কে অনেক তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে।
শিল্প সংশ্লিষ্ট এবং প্রতিরক্ষা খাত বিশেষজ্ঞরা সেসব তথ্যের ভিত্তিতে করেছেন বিশ্লেষণ। ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক পাইলট বিজয়ান্দর কে ঠাকুর সেই সূত্রধরে সুখই-৫৭ বিমানের আলোচিত বহুমুখী দক্ষতাগুলির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বিমানটি কোন কৌশলে রাশিয়ানরা কাজে লাগাচ্ছে বা এটির অস্ত্রসজ্জাই বা কেমন– সেদিকেও আলোকপাত করেছেন তিনি ইউরেশিয়ান টাইমসে।
ফাইটার জেট বিমানকে নানানভাবে কাজে লাগানো হয়। তবে সব বিমানকে সবকাজে লাগানো যেমন যায় না, তেমনি সব বিমান সব কাজের জন্য প্রস্তুতও করা হয়নি। তাছাড়া, একটি বিমান কোন কোন ধরনের সক্ষমতায় কাজ করতে পারবে– তা নির্ধারণ করে এর পেলোড। বা এটি কোন ধরনের ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি বহন করবে তার ওপর।
সুখই-৫৭ প্রাথমিকভাবে তৈরি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-২২ র্যাপটরের হুমকি মোকাবিলায়। দুটি বিমানই তৈরি করা হয়েছে আকাশযুদ্ধে শত্রুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব বা এয়ার ডমিনেন্স প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য মাথায় রেখে। তবে উভয়েই বহন করতে পারে ভূমিতে আঘাত হানার মতো অস্ত্র ও সেন্সর। এই সক্ষমতাকেই বলা হয় বহুমখী কার্যসম্পাদনের দক্ষতা বা 'এসএমও'।
যতদূর জানা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুখই-৫৭ বিমানের এসএমও পরীক্ষার কথা ছিল। কিন্তু, ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয়ে যায় ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বেশ সাবধানে ও বুঝেশুনে রাশিয়া বিমানটিকে ইউক্রেনের অভিযানে ব্যবহার করছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাগালের বাইরে বা 'স্ট্যান্ডঅফ রেঞ্জ' থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং কৌশলগত তথ্য নেটওয়ার্ক পরিচালনার মধ্যেই সীমিত রাখা হয়েছে বিমানটির ব্যবহার।
সম্মুখভাগের স্টিলথ বৈশিষ্ট্য
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই আগে মনে করতেন, এফ-২২ বা এফ-৩৫ বিমানের চেয়েও সহজে সুখই-৫৭ শনাক্ত করতে পারবে ভূমিভিত্তিক রাডার।
তাদের অধিকাংশের জানেন যে, বিমানটির পার্শ্ব এবং পেছনের দিকের স্টিলথ বৈশিষ্ট্য অসামান্য কিছু নয়। কিন্তু, এটা জানেন না অথবা জেনেও বলেন না যে, সামনের দিকে এই বৈশিষ্ট্য বেশ ভালো।
আকাশে মার্কিন বিমান বাহিনীর উড়ন্ত রেডার স্টেশনই বলা যায় ই-থ্রি বা ই-এইট অ্যাওয়াকস বা এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোলকে। সুখই-৫৭ এর সামনের দিকের স্টিলথ বৈশিষ্ট্য বেশ জোরালো হওয়ায় বিমানটি যদি ই-থ্রি বা ই-এইট বিমান যে উচ্চতায় ওড়ে তার সমান উচ্চতায় উড়ে এগুলির দিকে আসে- তবে এটিকে সামনে থেকে শনাক্ত করা বেশ কঠিন।
ফলে না অ্যাওয়াকস ব্যবস্থা, না ভূমি-ভিত্তিক রাডার কারো পক্ষেই ধেয়ে আসা সুখই-৫৭ শনাক্ত করা সহজ নয়। আর যেহেতু আকাশ থেকে আকাশে বা আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সুখই-৫৭ শত্রুর দিকেই ধেয়ে আসছে– তাই এটিকে শনাক্ত করাও যাচ্ছে না।
ফলস্বরূপ, সহজেই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার রেঞ্জে এসে অশনাক্ত থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারছে সুখই-৫৭। ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা প্রযুক্তি এখানে কাজে আসছে না। ইউক্রেনের সীমান্তে টহলরত মার্কিন অ্যাওয়াকস বিমানগুলিও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
এয়ার- টু- এয়ার মিসাইল
জেনারেল সুরভকিনের বক্তব্যে ইঙ্গিত মেলে যে, শত্রুর লড়াকু জেটকেও ভূপাতিত করেছে সুখই-৫৭।
আকাশ থেকে আকাশে লড়াইয়ের জন্য সুখই-৫৭ বহন করতে পারে আর-৩৭এম দূরপাল্লার মিসাইলে, কে-৭৭এম মধ্য পাল্লার এবং স্বল্প পাল্লার আর৭৪এম২ এবং কে-এমডি মিসাইল।
এরমধ্যে আর৭৪এম২ বিমানটির ফিউজিলাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে বহনযোগ্য, এভাবে অস্ত্রবহন বিমানের স্টিলথ বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখতে সহায়তা করে।
ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানের সাথে সুখই-৫৭ লড়েছে বা ডগফাইটে অংশ নিয়েছে এমন কোনো খবর মেলেনি। এমনকী ইউক্রেনের আকাশে বিমানটিকে যেমন চাক্ষুষ দেখা যায়নি, তেমনি রাডারেও ধরা পড়েনি।
তাহলে ধরেই নেওয়া যায়, দূরপাল্লার মিসাইল ছুঁড়েই ইউক্রেনীয় বিমান ধবংস করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিমানটি আর-৩৭ এম মিসাইল ছুঁড়তে পারে, যার পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার।
ক্ষেপনাস্ত্রটি ডুয়েল পালস মোটর চালিত, আর লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি চলে আসার পর সর্বোচ্চ গতিতে আঘাত হানে। ফলে শত্রুবিমানের পাইলটের পক্ষে ধেয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রের 'লক' কাটানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এমন আরেকটি মিসাইল হচ্ছে ১৯০ কিলোমিটার পাল্লার কে-৭৭এম। 'এক্টিভ হোমিং' বা লক্ষ্যবস্তুতে অবিচল থেকে ছুটে চলা নিশ্চিত করতে দুটি মিসাইলেই আছে এসা (এইএসএ) সিকার।
আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানার অস্ত্র
বিমানের ফিউজিলাজ বা মূল কাঠামোর অভ্যন্তরে অস্ত্র রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা, তাকে সামরিক পরিভাষায় বলা হয়– 'ইন্টার্নাল বম্ব বে'। এতে করে সে শত্রুর নাগালের বাইরে থেকে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা বহন করতে পারে।
এতে যেসব অস্ত্র বহন করা যায়:
১. কেএইচ-৫৮ রাডার-বিধ্বংসী মিসাইল, পাল্লা ২৪৫ কিলোমিটার;
২. কেএইচ-৫৯এমকে২ ক্রুজ মিসাইল, পাল্লা ২৮৫ কিলোমিটার
তালিকায় আরও আছে এক্স-৫৯ মিসাইল। এটি নিক্ষেপের পর নিজে নিজেই ভূমিতে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে ধবংস করতে সক্ষম।
এই ক্ষেপণাস্ত্র শত্রুর অতি-শক্তিশালী ও পুরু কংক্রিটে নির্মিত বাঙ্কার ধবংস করতে সক্ষম। বিস্ফোরিত হয় বাঙ্কারের দেওয়াল ভেদ করে ভেতরে পৌঁছানোর পর। ৩৬০ কেজি বিস্ফোরক থাকায় এর ওয়ারহেড অতি-মারাত্নক।
সহজভাবে বললে, রুশ বিমানটি অতি-সক্ষম একটি অস্ত্র। অন্তত, রাশিয়া যে কৌশলে এটি ব্যবহার করছে, সেক্ষেত্রে এ দাবি করাই যায়। এতে করে, সুখই-৫৭ রাশিয়ার আরেকটি অকার্যকর অস্ত্র বা এটি সম্পর্কে রুশ সরকারের সব তথ্যই অতি-রঞ্জিত বলে পশ্চিমা দুনিয়া যে বিশ্বাস করেছে– তাতেও চিড় ধরেছে।