ইউক্রেন যুদ্ধ: আমেরিকা-ন্যাটোর ছায়াযুদ্ধের ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ!
ইউক্রেনে যুদ্ধ ঘিরে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ভয়- কাঁপাচ্ছে পুরো দুনিয়া। এ ভীতি বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষকে আতঙ্কিত করেছিল কিউবার মিসাইল সংকটকালেও। তখন ছিল এক স্নায়ুযুদ্ধের কাল। বর্তমান সময়টাও তেমনই। আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার বিরোধীতা করছে চীন ও রাশিয়া। ভূরাজনীতির অনেক বিশেষজ্ঞ উভয় শিবিরের বৈশ্বিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতাকে বলছেন দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের আগপর্যন্ত বিরোধী পরাশক্তিগুলো একে-অন্যের প্রভাব বিস্তার রুখতে পরোক্ষভাবে লড়েছে, নিজ নিজ মিত্রদের সহায়তা দিয়েছে। ইউক্রেনেও কী বর্তমানে তাই চলছে? এনিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন আমেরিকার টুফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌশলগত অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক মনিকা ডাফি টফট। এশিয়া টাইমসের সূত্রে তার বিশ্লেষণের ভাবানুদিত ও পরিমার্জিত অংশ টিবিএসের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—
৯ মাসে পা দিয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। পুরো সময়টা ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ। পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার মতো সাবেক সোভিয়েত বলয়ের ন্যাটো সদস্যরা তো তাদের সর্বোচ্চটা দিচ্ছে। সবাই মিলে ব্যতিব্যস্ত রাশিয়াকে হারাতে। জোটবদ্ধ হয়ে তারা দিচ্ছে সর্বাধুনিক অস্ত্র ও অর্থ।
পশ্চিমারা প্রশিক্ষণও দিচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে। দিচ্ছে রুশ অবস্থানে নির্ভুল আঘাত হানার মতো কার্যকর গোয়েন্দা তথ্য। এপর্যন্ত ইউক্রেনীয় বাহিনীর যে সাফল্য, সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা আছে কিয়েভের মিত্রদের। এক কথায়, স্নায়ুযুদ্ধের ধ্রুপদী চালেই- রাশিয়া ও পশ্চিমা দুনিয়ার ছায়াযুদ্ধের ময়দান আজ ইউক্রেন।
পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহে রূষ্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; দিয়েছেন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি। যদিও না আমেরিকা, না তার পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলি–কেউই দেয়নি এ যুদ্ধে নিজেদের আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। তখন থেকে দেশটিকে ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে শুধু যুক্তরাষ্ট্র। তবে পশ্চিমাদের দেওয়া সার্বিক সহায়তাকে নিরূপণ করাও কঠিন। কারণ প্রতিশ্রুতি যতোটা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কতটুকু দেওয়া হয়েছে– সেটি অস্পষ্ট রাখা হয় ।রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে অনেকক্ষেত্রেই গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। তাই অনানুষ্ঠানিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আমেরিকা এপর্যন্ত ইউক্রেনকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে বা তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অপরদিকে, মিলিতভাবে ২৯ বিলিয়ন ইউরোর বেশি আর্থিক, মানবিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলি। অবশ্য ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের পেছনে ব্যয় করা অর্থ এই হিসাবের বাইরে।
উদার এ সহায়তার হাত ধরেই রুশ বাহিনীকে ঠেকানো গেছে। পশ্চিমা সহায়তা, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ না পেলে রুশ অনুপ্রবেশের মুখে এতদিনে হেরেই যেত ইউক্রেন। সেখানে গঠিত হতো ক্রেমলিনের পছন্দের সরকার।
যুদ্ধ ও সামরিক হস্তক্ষেপের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি মনে করি, ইউক্রেনের পরিস্থিতি ছায়াযুদ্ধের একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। এতে ধ্রুপদী সেসব উপাদান আছে, যা অতীতেও দেখা গেছে।
যেমন রুশ-বিরোধী শিবির এখানে নিজেরা যুদ্ধ করছে না। ঝুঁকিতে ফেলছে না নিজেদের বেসামরিক জনতা ও সৈনিকদের জীবন। কিন্তু, অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের জেনে নেওয়া উচিত– প্রক্সি বা ছায়াযুদ্ধ আসলে কী; কোন উদ্দেশ্যগুলি হাসিলে এটি সহায়তা করে। এই জ্ঞান আমাদের ইউক্রেনে আমেরিকা ও ন্যাটোর চলমান অনানুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততাকে বুঝতে সহায়তা করবে।
ছায়াযুদ্ধের পটভূমি
প্রক্সি বা ছায়াযুদ্ধের সংঘাত হলো– যে সংঘাতে বহিঃশক্তি নিজস্ব সেনাবাহিনী না পাঠালেও– যুদ্ধরত একটি দেশকে দেয় অস্ত্র, প্রশিক্ষক, পরামর্শক, নজরদারির ড্রোন, অর্থ এবং এমনকী ভাড়াটে যোদ্ধা সহায়তা। এর প্রধান লক্ষ্যই হয়– কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল বা বিরোধী পক্ষের শাসকগোষ্ঠী বদল।
অতীতের বেশিরভাগ প্রক্সিযুদ্ধে– অন্য দেশে চলমান যুদ্ধের ফলাফল নিজ অনুকূলে আনতেই একটি বিদেশি শক্তির সরকার সেখানে সহায়তা দিয়েছে। যেমন ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ইন্দোচিনে ফরাসি নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ফ্রান্সকে যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া যানসহ অন্যান্য অস্ত্র দিয়েছে আমেরিকা। এর মাত্র একবছর পর ১৯৫৫ সালে শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। তখন আমেরিকাই সরাসরি জড়িয়ে পড়ে।
ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে একটি সরকার সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা না করে বা নিজস্ব সেনাবাহিনী না পাঠিয়েই– প্রতিপক্ষকের ক্ষয়ক্ষতি করার সুযোগ পায়। কখনো আদর্শিক মিত্র, কখনোবা 'শত্রুর শত্রু– আমার মিত্র' এই নীতির আওতায় বৈদেশিক শক্তি সহায়তা পাঠায়।
তবে অন্যের যুদ্ধে সমর্থন দানে সব দেশের সরকারের সমান আর্থিক সক্ষমতা থাকে না। ঠিক একারণেই বৈশ্বিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী– যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার সরকার– বেশিরভাগ ছায়াযুদ্ধে অর্থায়ন করে।
১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালীন চার্টারে আত্মরক্ষা ছাড়া অন্য যেকোনো উদ্দেশ্যে যুদ্ধকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই আমেরিকাসহ অন্যান্য প্রধান শক্তিগুলোর কাছে উদ্দেশ্য হাসিলের এক আদর্শ হাতিয়ারে পরিণত হয় প্রক্সি লড়াই।
তাছাড়া, স্নায়ুযুদ্ধের কালে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– বিরোধী দুই শিবিরের কাছেই ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের বিপুল মজুত। তাই তাদের মধ্যে সরাসরি সংঘাত এড়ানোও ছিল জরুরি। উভয় পক্ষই সেকারণে একে-অন্যের তৃতীয় কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপকে ব্যর্থ করতে ছায়াযুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করে।
আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এঙ্গোলোর মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ছায়াযুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এ যুদ্ধে সমাজতন্ত্র ও দেশটির তেল সম্পদ – দুইই ছিল প্রধান কারণ। ১৯৭০ ও ৮০'র দশকে এল সালভেদরে সমাজতন্ত্রের উত্থান নিয়েও উদ্বেগে ছিল আমেরিকা।
এসব পরোক্ষ সংঘাতের মাধ্যমে উভয় দেশের সরকার– বিরোধী পক্ষের স্বার্থের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করার সুযোগ পেয়ে যায়।
বিদেশি একটি সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠারও সহায়ক হতে পারে প্রক্সি যুদ্ধ। যেমন স্নায়ুযুদ্ধকালে ছোট কোনো দেশের গৃহযুদ্ধে সরাসরি এক পক্ষকে সমর্থন দিলে আমেরিকাকে দুর্বলের ওপর নিপীড়ক শক্তি হিসেবে সমালোচিত হতে হতো। কিন্তু, ওই দেশে চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীকে রুখতে আমেরিকা তার আদর্শিক মিত্রকে সহায়তা দিচ্ছে– ওয়াশিংটনকে এমন জোর সাফাই দেওয়ার সুযোগ করে দেয় ছায়াযুদ্ধ। এই সম্পৃক্ততাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একান্ত 'অপরিহার্য' বলার সুযোগও তৈরি হয়।
মস্কো বা ওয়াশিংটন তথা পশ্চিমা প্রচারযন্ত্রের শক্তি– এই যুক্তিকেই প্রতিষ্ঠা করতো।
গত মার্চ থেকেই ইউক্রেনে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে রুশ অভিযান। তখন থেকেই পশ্চিমাদের হুমকি দিয়ে চলেছেন পুতিন। তিনি স্পষ্ট করেও বলেছেন যে, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল।
তাই পুতিন বলছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ছে। কথাটি তিনি বাড়িয়েও হয়তো বলেননি। আবার এই যুক্তি দিয়েই ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতেই হবে এমন বার্তা দিচ্ছেন। ধরে রাখতে চাইছেন, যুদ্ধের পক্ষে অভ্যন্তরীণ সমর্থন।
ন্যাটো জোট যদি ইউক্রেনের কাঁধে বন্দুক রেখে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে সফল হয়– তাহলে প্রভাবশালী সব সরকারই আবার ছায়াযুদ্ধকে একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ উপায় হিসেবে দেখা শুরু করবে। কিন্তু, এতে যদি রাশিয়া মরিয়া হয়ে ন্যাটো দেশে সরাসরি হামলা করে বসে; বা ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে– তাহলেই ছায়াযুদ্ধ রূপ নেবে সরাসরি সংঘাতে বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আশা, আমাদের প্রজাতি-বিনাশী এই সম্ভাবনা যেন কখনোই বাস্তবে রূপ না নেয়।