সেনাবিরোধী বক্তব্যের জন্য সংসদে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন ইমরান?
বৃহস্পতিবারের (৩ নভেম্বর) বন্দুক হামলার জন্য পাকিস্তানের বর্তমান জোট সরকার এবং সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আভিযুক্ত করেছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান। প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলায় ইমরানকে মানহানির মামলায় জাতীয় সংসদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। যদিও আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ সরকারের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন অবলম্বনে।
পাকিস্তানের সংবিধানের ৬৩ (১জি) নং ধারা অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী এবং বিচার বিভাগের প্রতি অসম্মানজনক কোনো বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডের জন্য একজন আইনপ্রণেতা বা সংসদ সদস্যকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। ইমরানের বিরুদ্ধে আইএসপিআর যে বিবৃতি দিয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধান অনুযায়ী এই পদক্ষেপ নিতেই পারে। বেশকিছু আইন বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এমনটিই মনে করছেন।
তবে ওই অনুচ্ছেদের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করতে হলে অবশ্যই তাকে আগে আদালত থেকে দোষী সাব্যস্ত হতে হবে।
শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় পিটিআই চেয়ারম্যান এক টেলিভিশন ভাষণে, তাকে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রে সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন সেনা কর্মকর্তা যুক্ত থাকার অভিযোগ করেন। সেই বক্তব্যের কয়েকঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনী নিজেদের পক্ষে বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগগুলো 'অগ্রহণযোগ্য এবং অযাচিত'। একইসঙ্গে তার বক্তব্যের জন্য প্রশাসনকে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানানো হয়।
তবে আশ্চর্যজনক ব্যপার হলো, পিটিআইয়ের একজন ভিন্নমতাবলম্বী এমএনএ নূর আলম খান শুক্রবার ইমরানের বক্তৃতা এবং আইএসপিআর-এর বিবৃতির আগেই দেশটির জাতীয় পরিষদে সরকারকে সংবিধানের ৬৩(১জি) নং ধারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
এদিকে, পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির (পিলডাট) সভাপতি আহমেদ বিলাল মাহবুব মনে করেন, ইমরান খানের অভিযোগ তদন্তে প্রধান বিচারপতিকে সরকারের একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্ট কমিশন গঠন করতে বলার পদক্ষেপটি যথাযথ হয়েছে। তবে সশস্ত্র বাহিনীকে অসম্মান করার যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রক্রিয়াটি জটিল এবং দীর্ঘ হবে।
তিনি বলেন, বিষয়টি সরকার যেকোনো উচ্চ আদালতে নিয়ে যেতে পারে; কিন্তু সম্ভবত সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি সরাসরি নিতে চাইবে না। এজন্য হয়তো সরকারকে দায়রা আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে, সেখানে আবার ইমরান আপিলের সাংবিধানিক অধিকার পাবেন না।
আইএসপিআর-এর বিবৃতির পর পরিস্থিতি নিয়ে আহমেদ মাহবুব আফসোসের সুরে বলেন, সংবিধান শুধু বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীকেই সুরক্ষা দিচ্ছে; বিগত বহু বছর ধরেই ইমরান খান শুধু সেনাবাহিনী নয় বরং রাজনীতিবিদ, আমলা এবং এমনকি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও নানান ধরনের অভিযোগ তুলে আসছেন। কিন্তু সংবিধানে তাদেরকে ভিত্তিহীন অভিযোগে দায়ী করার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার তেমন স্পষ্ট কোনো নিয়ম নেই।
পাকিস্তানের ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নেটওয়ার্ক-এর প্রতিনিধি মুদাসির রিজভীও সুপ্রিম কোর্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার ব্যাপারে আহমেদ মাহবুবের সঙ্গে একমত হয়েছেন। এক্ষেত্রে নওয়াজ শরীফের উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, এমন পদক্ষেপে নওয়াজ শরিফের সময় আপত্তি তুলেছিল সুশীল সমাজ। কারণ তিনি তখন আপিলের সুযোগ পাননি।
রিজভী বলেন, যোগ্যতা এবং অযোগ্যতা নিয়ে অনেক রকম ধারাই রয়েছে, তবে সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো সুস্পষ্ট পদ্ধতির উল্লেখ নেই।
এমনকি, স্পষ্টতার অভাবে তোশাখানা মামলায় ইসিপি দ্বারা অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরেও উপনির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান। যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ আইনি পদ্ধতি তৈরির প্রয়োজন ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাশিফ আলি মালিক জানান, সংবিধান সংশোধনের আগে ৬৩(১)(জি) মূল ধারা অনুযায়ী, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ছাড়াও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। তবে ২০১০ সালে ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় সেই পথ।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে আদালত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যের জন্য অযোগ্য ঘোষণার আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী সম্পর্কে ভিন্নমত দিয়েছিলেন শরিফ। তবে সে সময় আদাতের রায়ে বলা হয়েছিল, শরিফকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না, কারণ তিনি উপযুক্ত আদালতে দোষী সাব্যস্ত হননি।
এদিকে, নিজের আরেক বক্তব্যের জালেও জড়িয়ে যেতে পারেন ইমরান। তার দাবি, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আগেই তথ্য পেয়েছেন তিনি। এর ওপর ভিত্তি করে তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে বিচার শুরু করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান হাইকোর্টের আরেক আইনজীবী হাসনাইন কাজমি বলেন, এটি করা যেতে পারে। তবে তা সরকারের জন্যই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এই পদক্ষেপ নেওয়া হলে এতে গোয়েন্দা সংস্থার ওপরেও অঙুল উঠতে পারে। একই অপরাধে অভিযুক্ত করা হতে পারে সংস্থা।