রাশিয়া- ইউক্রেন শস্য রপ্তানির কেন্দ্রে রয়েছেন যে রুশ ধনকুবের সার ব্যবসায়ী
রাশিয়ার বাইরে বহির্বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশি পরিচিত সাবেক ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার নিকিতার বাবা হওয়ার সুবাদে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর- আমেরিকার হাস এফ-১ টিম থেকে বাদ পড়েন নিকিতা। গণমাধ্যমে তখনই তার পারিবারিক পরিচিতিটা নিয়ে আলোচনা হয়। তার ধনকুবের পিতা দিমিত্রি মাজপিন সম্পর্কেও মানুষ কিছুটা জানতে পারে। যদিও পাদপ্রদীপের কেন্দ্রে ছিলেন নিকিতাই। খবর ব্লুমবার্গের
কিন্তু, বর্তমানে দিমিত্রি মাজপিনের প্রতিষ্ঠিত সার ব্যবসার সাম্রাজ্যই আলোচনার কেন্দ্রে। ধনকুবের এই ব্যবসায়ীর ক্রেমলিনে প্রভাব এবং কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানির আন্তর্জাতিক সমঝোতায় তার ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ভলগা নদী থেকে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর পর্যন্ত চলে গেছে এক দীর্ঘ অ্যামোনিয়াবাহী পাইপলাইন। এরপর তা জাহাজে করে রপ্তানি করা হয়। এই অ্যামোনিয়া উৎপাদন করে মাজপিনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বন্ধ করে দেওয়া হয় এ পাইপলাইন। এদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্য সরবরাহ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। তখন জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্ততায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানির চুক্তি হয়। আগামী পরশু অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হবে। এটি পুনঃনবায়ন করার অন্যতম শর্ত হিসেবে- অ্যামোনিয়াবাহী পাইপলাইনটি সচলের দাবি করেছে রাশিয়া।
এর আগে রাশিয়া, জাতিসংঘ, তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায়–যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে ১ কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে আনা গেছে। আগস্টে কার্যকর হওয়া এ সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার মতো প্রধান শস্যের ঘাটতি মোকাবিলার লক্ষ্য নেওয়া হয়, যাতে দরিদ্র দেশে খাদ্য সংকট আরও তীব্র না হয়।
চুক্তিটির মেয়াদ বৃদ্ধিও সম্পন্ন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) শুভ সংবাদটি জানান, জাতসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ইউক্রেনের বন্দর দিয়ে দেশটির খাদ্যশস্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোয়- তিনি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অভিনন্দন জানান।
মহাসচিব এদিন এক বিবৃতিতে বলেন, 'ইউক্রেন থেকে কৃষ্ণসাগর হয়ে শস্য, খাদ্যপণ্য এবং সার নিরাপদে পরিবহনের উদ্যোগটি অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের এই প্রচেষ্টাকে আমি স্বাগত জানাই'।
চুক্তিটির অন্যতম শর্ত হিসেবে রাশিয়া থেকে খাদ্য রপ্তানিকেও বাধামুক্ত করার দাবি করেছে মস্কো। এপ্রসঙ্গে গুতেরেস বলেন, 'রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে খাদ্য ও সার রপ্তানির ওপর বিদ্যমান বাধাগুলি দূরীকরণে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জাতিসংঘ'।
এর আগে জাতিসংঘ এবিষয়ে মস্কোকে নিশ্চয়তাও দেয়।
চুক্তিটি নবায়নের মাধ্যমে পাইপলাইনটি সচল করা হচ্ছে কিনা– সে সম্পর্কে তাৎক্ষনিকভাবে জানা যায়নি। জাতিসংঘের নিযুক্ত রাশিয়ার প্রতিনিধির বরাতে এনিয়ে আরও আলোচনা চলছে বলে চুক্তি নবায়নের আগে গতকাল বুধবারেই জানায় রুশ বার্তাসংস্থা– রিয়া নভোস্তি। অ্যামোনিয়া রপ্তানি বেশ স্পর্শকাতর হওয়ায় এই আলোচনা আরও কিছুদিন চলতে পারে। আর শর্তটি না মানলে রাশিয়ার তরফ থেকে চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
অ্যামোনিয়া অত্যন্ত দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় হওয়ায় যুদ্ধকালে পাইপলাইনটি সচল করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পুনরায় চালু করতে হলে উভয় পক্ষের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আস্থা তৈরি হতে হবে। পাইপলাইনটি যুদ্ধের আগুনে পুড়বে না- এই নিশ্চয়তা একে-অপরকে দিতে হবে কিয়েভ ও মস্কোর। এই পদক্ষেপ যেন নিরাপদ হয় এবং দরিদ্র বিশ্বের কল্যাণে আসে– সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে বোঝাপড়াও থাকতে হবে বলে মনে করেন চিন্তক সংস্থা- চ্যাথাম হাউজের 'ইমার্জিং রিস্ক' শাখার গবেষণা পরিচালক টিম বেন্টন।
তিনি বলেন, 'বিশ্ববাজারে খাদ্যের লভ্যতা ও দামের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে– কৃষ্ণসাগর হয়ে শস্য এবং রাশিয়ার সার রপ্তানি নিশ্চিতকরণ হবে খুবই ইতিবাচক। এটি রাশিয়ার অর্থনীতিতেও ব্যাপক সহায়তা দেবে'।
যুদ্ধের আগে রাশিয়া ছিল- বিশ্বের বৃহত্তম সার রপ্তানিকারক। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে করতো মোট খাদ্যশস্য রপ্তানির ২৫ শতাংশ। যুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দরগুলি অবরোধ করলে, দেশটি থেকে সমুদ্রপথে শস্যের চালান পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যে ঘটে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। এই বাস্তবতায়, জুলাইয়ে সই হয় কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানির চুক্তি। এর মাধ্যমে আগস্ট থেকে শস্য রপ্তানি শুরু করে ইউক্রেন।
মাজপিনের দুর্দশা
শস্য রপ্তানির আলোচনার সময় রাশিয়া গুরুত্ব দেয় অ্যামোনিয়া পাইপলাইনটি সচল করার ওপর। এতে লাভবান হবে তোগলিয়াত্তাজট পিজিএসসি।
একইসঙ্গে, ইউরোপের বন্দরগুলিতে উরালচেম জেএসসি'র আটকে রাখা ৩ লাখ টন সারের চালান ছেড়ে দেওয়ার দাবি তোলে মস্কো। সরকারের এই দাবিতে, বেশ বিস্মিত হন রাশিয়ার সার শিল্পের শীর্ষ নির্বাহীরা। কারণ, আলোচিত দুটি কোম্পানিতেই রয়েছে মাজপিনের মালিকানা। এবিষয়ে জানতে উরালচেম, তোগলিয়াত্তাজট এবং মাজপিনের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করে ব্লুমবার্গ। কিন্তু, তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একটা বিষয় স্পষ্ট, তা হলো– ক্রেমলিনের ওপর মাজপিনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তবুও যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার যেসব ব্যবসা প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়ে– তার মধ্যে মাজপিনের ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্যও রয়েছে। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাধ্য হয়ে তিনি উরালচেমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, রাশিয়ার বৃহত্তম পটাশ সার উৎপাদক উরালকালি পিজিএসসি'র নিয়ন্ত্রণে ছাড় দেওয়ার বিষয়েও। ইউরোপের বন্দরগুলি ব্যবহারও বন্ধ করা হয় উরালচেমের জন্য। অথচ এসব বন্দর ছিল কোম্পানিটির প্রধান রপ্তানি রুট।
ইউরোপে জাহাজে করে সার রপ্তানির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ওডেসা পর্যন্ত বিস্তৃত পাইপলাইনটি চালু হওয়া অতি-জরুরি তোগলিয়াত্তাজট- এর জন্য। কারণ এখান থেকেই সারের চালান তারা ইউরোপে পাঠাত।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো– ১৩ বছর বাণিজ্যিক বিরোধ চলার পর– আদালতের রায়ে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর স্বল্পসময় আগে তোগলিয়াত্তাজট এর নিয়ন্ত্রণ পান মাজপিন।
কোম্পানিটিতে প্রথমে সামান্য বিনিয়োগ করেছিলেন মাজপিন। পরে কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে- তাদের অপসারণ করা হয়। কাউকে কাউকে তাদের অনুপস্থিতিতে কারাদণ্ডও দেন আদালত।
এক বছর আগে নিজেদের দেওলিয়া ঘোষণা করেন তোগলিয়াত্তাজট এর সাবেক মালিকেরা। ওই বছরের (২০২১ সালের) ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় কোম্পানির ৭১ শতাংশ মালিকানা কিনে নিতে সক্ষম হয় মাজপিনের ফার্মগুলো।
এই অধিগ্রহণের মাধ্যমে মাজপিনের কোম্পানিগুলোর সার উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু, পাইপলাইনটি ছাড়া এই সক্ষমতা বৃদ্ধি নিষ্ফল হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দেশটির অল্প যে কয়েকজন ব্যবসায়ী সাক্ষাতের সুযোগ পান তাদের মধ্যে ছিলেন মাজপিনও।
ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ীর মোট সম্পদ প্রায় ৯০ কোটি ডলার বলে প্রাক্কালন করা হয়েছে ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার ইনডেক্সে। তার সাথে রয়েছে স্বদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এদের মধ্যে আছেন, রসটেক স্টেট কর্পোরেশনের প্রধান এবং উরালকালির সাবেক চেয়ারম্যান সের্গেই চেমেজভ। পুতিন পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে কেজিবির এজেন্ট থাকার সময়–চেমেজভ তার সহকর্মী ছিলেন।
মাজপিনের জন্ম সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলারুশে। তিনি সামরিক স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৮০'র দশকে একজন সামরিক দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আফগানিস্তানে।
বেসামরিক জীবনে ফিরে ব্যাংকিং খাতে যোগ দেন। কিছুদিন চাকরি করেন তেল কোম্পানি টিএনকে'তে। ২০০০ এর দশকের শুরুতে মাজপিনের উত্থান হতে থাকে। এসময় তিনি দেশটির সর্ববৃহৎ পেট্রোকেমিক্যাল হোল্ডিং সিবুর- এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সাহায্যেই কোম্পানিটির সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা– গ্যাজপ্রম। এসময়েই অ্যামোনিয়া প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনা শুরু করেন মাজপিন। এবং ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উরালচেম।
তবে ২০১৩ সালের আগপর্যন্ত টাইকুনদের কাতারে উঠে আসেননি তিনি। এবছর পটাশ উৎপাদক উরালকালির কিছু অংশ কিনে নেন। এসময় প্রমাণ মিলেছিল তার রাজনৈতিক প্রভাবের। কারণ, এই ক্রয়ের জন্য দরকারি ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ বিনা বাক্যব্যয়ে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক- ভিটিবি।
তবুও অনিশ্চয়তা যেখানে
শস্য রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়– এবার রপ্তানি বাজার ফিরে পাবার আশা করতেই পারেন মাজপিন।
চুক্তিটি প্রথম স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়েই রাশিয়া থেকে অবাধে সার রপ্তানির প্রতি সম্মতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে অধিকাংশ ব্যাংক, বীমাদাতা ও জাহাজে পণ্য পরিবাহী সংস্থা–এই রপ্তানিতে অংশ নিতে আগ্রহী নয়। এই বাধাগুলি দূর করতে জাতিসংঘকে ভূমিকা নিতে বলেছে রাশিয়া।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, পাইপলাইনটি সচল হলে শস্য রপ্তানি চুক্তি নিয়ে সব বিবাদের অবসান হবে। ফলে নির্বিঘ্নে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মানুষের কাছে খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদনে দরকারি সার সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তবে গেল সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়ার হাতে থাকা ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিলেই পাইপলাইনটির নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব।
তাৎক্ষণিকভাবে এই দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায় মস্কো।
এপ্রসঙ্গে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের উদীয়মান বাজার বিষয়ক অর্থনীতিবিদ এভগেনিয়া স্লেপতেসোভো বলেন, 'জেলেনস্কি শুধু অর্থনৈতিক বিনিময় চাননি, বরং বন্দী বিনিময় চেয়েছেন। এটি রাশিয়া এক কথায় নাকচ করেছে, কারণ দেশটির জানা আছে- ভবিষ্যতে আলোচনার টেবিলে যুদ্ধবন্দী বিনিময় তাদের বিশেষ সুবিধা দেবে'।
তাই মাজপিনের ব্যবসায়ীক ভবিষ্যৎ এখনও যে অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা– তা বলা অবান্তর হবে না।