কে এই রাজা আল সুলতান, যিনি মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করলেন!
মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ করেই বহিষ্কৃত এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এক অদ্ভুত সময়ে আবারো দেশটির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হলেন।
এর আগে গত শনিবার দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সরকার গঠনের জন্য ১১২টি আসনের কোটা কোনো জোটই পুরণ করতে পারেনি। ফলে হস্তক্ষেপ করতে হয় রাজা সুলতান আহমেদ শাহকে। তার তত্ত্বাবধানেই আনোয়ার ইব্রাহিম এবং মুহিইদ্দীন ইয়াসিনের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা ঠিক করা হয়। বৃহস্পতিবার রাজপরিবারগুলোর সাথে বৈঠক করে বিকাল ৫টায় আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পাঠ করানো হবে।
তবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেন রাজা ঠিক করলেন? কী তার পরিচয়?
কে এই মালয়েশিয়ার রাজা?
২০১৯ সালে ৫৯ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন আল সুলতান আহমেদ শাহ। ১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে তিনি ষোড়শ রাজা হিসেবে এ পদ অলঙ্কৃত করলেন।
মালয়েশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী নয়টি প্রদেশের নয়টি রাজপরিবারের রাজা পাঁচ বছরের জন্য রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। এভাবে ৫ বছর পর আরেক প্রদেশের আরেকজন রাজা পুরো মালয়েশিয়ার রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। এর আগের রাজা হঠাৎ করেই পদত্যাগ করলে ধূসর চুলের চশমা পরা আল সুলতান আব্দুল্লাহ রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন।
মালয়েশিয়ার পূর্ব উপকূলের পাহাং প্রদেশের রাজা আল সুলতান আব্দুল্লাহ নিজের বিনয়ী স্বভাবের জন্য মালয়েশীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, বিশেষ করে যখন কেএফসিতে সবার সাথে একই লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার কেনার ছবি কিংবা হাইওয়েতে দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্য করার ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
আল সুলতান আব্দুল্লাহ খেলোয়াড় হিসেবেও বেশ পরিচিত। যুবক বয়সে তিনি তার প্রদেশের ফুটবল দলের হয়ে খেলেছেন। ফিফা এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য এবং এশিয়ান হকি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
সবসময় কি রাজাই ঠিক করেন?
সাধারণত সংসদীয় পদ্ধতিতেই মালয়েশিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। তবে সংবিধান রাজাকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যেখানে তিনি এমন কাউকে নির্বাচন করতে পারবেন যার দেশের অধিকাংশ মানুষকে পরিচালনা করার মতো সামর্থ্য রয়েছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙতে রাজা সেখানে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখেন।
মালয়েশিয়ার রাজাদের এই ক্ষমতা ব্যবহারের ইতিহাস একেবারেই বিরল, কিন্তু গত দুই বছরে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজাকে এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে বাধ্য করেছে, যেখানে তাকে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা ঠিক করতে হয়েছে। ২০২০ সালের পর থেকেই মালয়েশিয়ার একসময়ের প্রভাবশালী জোট বারিসান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এবং এর প্রধান দল ইউনাইটেড মালয়েজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের প্রভাব কমতে থাকে। তারপর থেকে রাজাকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হয়েছে।
১৯৫৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বারিসান প্রতিবারই সরকার গঠন করেছে, ২০১৮ সালে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। মাল্টিবিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ১এমডিবিতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ইউএমএনও-এর সাবেক নেতা নাজিব রাজাক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
এর আগে কি কখনো এটি হয়েছে?
রাজা আল সুলতান আব্দুল্লাহ এর আগেও দুইবার প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছেন। তবে এই প্রথমবার নির্বাচনের পর রাজাকে প্রধানমন্ত্রী ঠিক করতে হলো, যেখানে দুইজনের কেউই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন দখল করতে পারেননি।
২০২০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদ জোটের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখতে পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন রাজা আব্দুল্লাহ দেশের ২২২ জন সাংসদের সাথে আলোচনা করে কার পক্ষে বেশি সমর্থন রয়েছে তার ভিত্তিতে মাহাথিরের সহযোগী মুহিইদ্দীন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঠিক করেন।
এক বছরের মধ্যেই, মুহিইদ্দীনের নিজের জোটও ভেঙে পড়ায় রাজা প্রত্যেক সাংসদকে একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম পাঠানোর নির্দেশ দেন। সাংসদদের নাম পাঠানোর ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের ওপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেন রাজা আল সুলতান আব্দুল্লাহ।
মঙ্গলবার রাজা আনোয়ার এবং মুহিইদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুহিইদ্দীন জানান যে, রাজা তাদেরকে একসাথে সরকার গঠন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, কিন্তু দুজনের কেউই এ ব্যাপারে একমত হননি। এরপর রাজা বারিসান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের ৩০ জন সাংসদকে দায়িত্ব দিয়ে বুধবারের মধ্যে কে প্রধানমন্ত্রী হবে তা ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেন পাকাতান হারাপান জোটের আনোয়ার ইব্রাহিম। তবে শেষ কয়েক বছরে মালয়েশিয়া যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটির মুখোমুখি হয়েই দায়িত্ব পালন করতে হবে তাকে।