রুশ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ বাখমুতের পতনও কি আসন্ন?
ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলের যুদ্ধে কৌশলগত গুরুত্বের শহর বাখমুত। রুশ ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে এখানে কয়েক মাস ধরে চলছে প্রচণ্ড লড়াই, যা রূপ নিয়েছে ভয়াবহ এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে। যোগাযোগ হাব হওয়ায় কৌশলগত সামরিক অবস্থানের পাশাপাশি, এর নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেন ও রাশিয়ার কাছে রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর, বাখমুত উভয় পক্ষের জাতীয় সম্মানের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে এতদিনে। খবর ওয়াশিংটন পোস্টের
এখানে রুশ ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর ব্যাপক শক্তিক্ষয় ঘটছে। প্রতিনিয়ত তারা হারাচ্ছে সেনা ও সরঞ্জাম। কিন্তু, ইউক্রেনের ওপর রণাঙ্গনের অন্যত্র পাল্টা-আক্রমণ অভিযান পরিচালনার চাপ রয়েছে। বাখমুতে তারা লড়াই অব্যাহত রাখলে যা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে উঠবে।
বিগত কিছু দিনে বাখমুতে নতুন করে আক্রমণ করছে রুশ সেনারা। তাদের রুখতে মরিয়া ইউক্রেনীয়রা, ফলে প্রচণ্ড নির্মম এক লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছে, এসব লড়াই যেন বাখমুতের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধেরই প্রতীক। নিকটবর্তী শহর সোলেদার দখলেও এগোচ্ছে রুশ বাহিনী। ইতোমধ্যেই তারা লবণ খনি সমৃদ্ধ শহরটির বড় অংশ দখলে নিয়েছে এবং এখান থেকে বাখমুতে হামলার পরিকল্পনা করছে।
সামরিক সরঞ্জাম ও জনবলে এগিয়ে থাকার পরও, বাখমুত দখলে নিয়ে কয়েক মাস ধরে লড়তে হচ্ছে রুশ বাহিনীকে। ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ অবস্থান লক্ষ্য করে, তারা চালিয়ে যাচ্ছে আক্রমণ। এতে সেনা হতাহত হলেও পরোয়া করছে না রাশিয়া। নব উদ্যমে আবারো আক্রমণ করা হচ্ছে। মস্কো সেনা ও সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়েই যে বাখমুতে জয়ী হতে চাইছে– এ কৌশল তারই উদাহরণ।
বাখমুতের দক্ষিণে মোতায়েন করা ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের ডেপুটি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার অ্যান্দ্রিঁ ক্রিশেচেঙ্কো বলেন, 'আমরা যদি তাদের ১০ সেনার মধ্যে ৫ জনকে হত্যা করি, তাহলে সংখ্যার এই ঘাটতি নতুন সেনার মাধ্যমে পূরণ করে– কয়েক ঘণ্টা পর আবার হামলা চালায় তারা'।
তিনি আরো জানান, 'ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ করে ওরা, হতাহতদের ঘাটতিও দ্রুত পূরণ করছে। এভাবে রাশিয়ানরা আমাদের প্রতিরোধ অবস্থানগুলোতে হামলা করে, কখনো কখনো– একদিনে পাঁচ, ছয় বা সাতবার পর্যন্ত'।
লড়াইয়ের মূল্য ইউক্রেনকেও দিতে হচ্ছে। আর এনিয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগ আর চাপা থাকছে না। পশ্চিমা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের সেনাদের উচিত বাখমুত থেকে পিছু হঠা। এতে করে, তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ যুদ্ধের অন্য প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবে।
পশ্চিমা সমর বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে তারা দাবি করছে, যুদ্ধের সার্বিক গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে বাখমুতের কৌশলগত গুরুত্ব নেই তেমন। তবু প্রতীকী রাজনৈতিক মর্যাদার কারণেই উভয় পক্ষই এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়।
ইউক্রেন– যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে সম্প্রতি বড় সংখ্যায় সাঁজোয়া যান সরবরাহ পেতে চলেছে। এগুলো দিয়ে ইউক্রেনকে অন্য ফ্রন্টে হামলার পরামর্শ দিচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। ইউক্রেনের সামরিক কর্মকর্তারাও নতুন কাউন্টার-অফেন্সিভে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এর মাধ্যমে তারা রাশিয়ার দখলকৃত আরো এলাকা মুক্ত করতে চান। এই অভিযানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে– যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী যে অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম, মিত্রদের তার প্রমাণ দেওয়া। আর তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরো সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করা। ইউক্রেন যুদ্ধ পা দিয়েছে ১১ মাসে, এই সময়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহায়তা ধরে রাখাটাও কিয়েভের কাছে অসীম গুরুত্বের।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া-ভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা– সিএনএ'র রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর ওপর বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান বলেন, 'আক্রমণ অভিযানের জন্য ইউক্রেনীয়দের নতুন সেনা ইউনিট দরকার। এসব ইউনিটকে অস্ত্র-সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত করার কাজও শুরু হয়েছে। তাই প্রথমে বাখমুতের যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য সুবিধাজনক হলেও, এখন আর তা নয়। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বাখমুতের যুদ্ধে শক্তিক্ষয়, চলতি শীত বা আগামী বসন্তের মৌসুমে ইউক্রেনের সার্বিক লড়াই করার শক্তি কতোটা ব্যাহত করবে তা নিয়ে'।
এর আগে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সংস্থা– ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান বাখমুত দখলের লক্ষ্যস্থির করেন। তিনি ক্রেমলিনের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, রুশ সেনাবাহিনীকে যখন পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে, তখন তার বেসরকারি ভাড়াটে যোদ্ধারা রাশিয়ার হয়ে নতুন এলাকা দখলে নিতে সক্ষম।
এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল বলে মনে করছেন অনেক পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক। বাখমুতে রাশিয়ার ব্যাপক জনবল ও সরঞ্জামহানি তারই প্রমাণ বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন কর্মকর্তা সামরিক বিষয়টি ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর হওয়ায়, নাম না প্রকাশের শর্তে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন বাখমুতের প্রতিরোধে সফল হয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। যুদ্ধে রাশিয়ার অন্তত হাজার খানেক সেনা প্রাণ হারিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ইউক্রেনেরও।
'তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মর্যাদার বিষয়ে পরিণত হয়েছে বাখমুত। রাশিয়া এ শহর দখলে নিতে পারলে, গত গ্রীষ্মের পর ইউক্রেন যুদ্ধে একটি বড় বিজয় হিসেবে একে দেখাতে পারবে। অন্যদিকে, বাখমুতকে প্রতিরোধের দুর্গ হিসেবে তুলে ধরেছেন ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব'।
যেমন গত বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মার্কিন কংগ্রেস বা প্রতিনিধি পরিষদে ভাষণ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি। তিনি বাখমুতের যুদ্ধকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মোড় পরিবর্তনকারী 'ব্যাটেল অব সারাটোগার' সাথে তুলনা করেন এসময়। বাখমুতের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্বাক্ষর-সম্বলিত পতাকাও তিনি উপহার দেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং কংগ্রেসের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে।
ইউক্রেনীয়দের কাছেও জাতীয় চেতনার অংশ হয়ে উঠেছে বাখমুত। তাদের প্রায়ই স্লোগান দিতে শোনা যায়, 'বাখমুত হোল্ডস' বা বাখমুত এখনও টিকে আছে বা লড়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেনকে এখন পশ্চিমা সমর্থনের ওপর নির্ভর করে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে হচ্ছে। নতুন সেনা ভর্তি ও তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। বাখমুতের লড়াই এসব অনভিজ্ঞ সেনার জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠবে। আর অস্ত্র ও সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতিও হতেই থাকবে। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেনের ওপর সামনের মাসগুলোয় নতুন কাউন্টার-অফেন্সিভ অভিযান পরিচালনার চাপ রয়েছে মিত্রদের পক্ষ থেকে। রাশিয়ার নতুন করে যেসব আক্রমণ অভিযান পরিকল্পনা করছে, সেগুলো প্রতিহতের জন্যও রয়েছে একই রকম তাগাদা।
গেল নভেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ. মিলে বলেছিলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন পক্ষে এক লাখের বেশি সেনা হতাহত রয়েছে। এই বাস্তবতায়, বাখমুতে সামরিক জনবলের ক্ষয়ক্ষতিকে অহেতুক বলে মনে করা হচ্ছে।
তাছাড়া, নতুন অভিযানের উদ্দেশ্যেই ইউক্রেনকে ব্রাডলি আর্মার্ড ফাইটিং ভিহাইকেল নামে পরিচিত সাঁজোয়া যান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অভিযান সফল করতে হলে, অভিজ্ঞ সেনা চাই ইউক্রেনের। বাখমুতে দক্ষ সেনা হারালে, সাফল্য অধরাই রয়ে যেতে পারে কিয়েভের। এভাবেই বাখমুত নিয়ে আবেগ ও জাতীয় মর্যাদার চিন্তাচেতনা সার্বিকভাবে ইউক্রেনের জন্যই কালান্তক হবে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জনবলহানির কথা স্বীকার করে, নাম না প্রকাশের শর্তে- ইউক্রেনীয় এক কমান্ডার বাখমুতের যুদ্ধে তার ইউনিট ব্যাপক হতাহতের শিকার হয় বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'প্রতীকী গুরুত্বের এ লড়াইটা আমরা বুঝি। কিন্তু, সেখানে আমরা অনেক বন্ধুদের হারিয়েছি। এত আত্মত্যাগের পর শহরটি ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সাময়িকভাবে সেখান থেকে পিছু হটলে আমাদের অনেক সেনার প্রাণ রক্ষা পাবে'।