পশ্চিমা সাঁজোয়া যান যুদ্ধে ইউক্রেনকে আদৌ বাড়তি কোনো শক্তি যোগান দেবে?
পশ্চিমারা বহু যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়েছে ইউক্রেনকে। ১১ মাসব্যাপী এ যুদ্ধের একেক পর্বে সফলতার জন্য আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে একেকটি অস্ত্র। যেমন গত বছরের শীতে কিয়েভ প্রতিরক্ষার লড়াই চলাকালে গণমাধ্যমের শিরোনামে ছিল জ্যাভেলিন ট্যাংক-বিধবংসী এবং স্ট্রিংগার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। বসন্তে লড়াইয়ের কেন্দ্র ডনবাস অঞ্চল-ভিত্তিক যখন হয়ে ওঠে, তখন আলোচনার পাদপ্রদীপে আসে ১৫৫ মিলিমিটার হাউইটজার। শরতে ইউক্রেন যখন পাল্টা-আক্রমণ অভিযানে যায়, তখন এ কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছিল হিমার্স বা হাইমার্স রকেট লঞ্চারকে। যুদ্ধেলিপ্ত উভয়পক্ষ আসন্ন বসন্তে নতুন আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই বাস্তবতায় এখন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে সাঁজোয়া যান – ট্যাংক এবং ইনফেন্ট্রি ফাইটিং ভিহেক্যাল (এএফভি)। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে।
প্রায় এক বছরব্যাপী এ যুদ্ধে ইউক্রেন প্রতিরোধ লড়াইয়ে অনেকটা সাফল্য পেলেও, ক্রিমিয়া উপদ্বীপসহ এখনও দেশটির প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা রাশিয়ার দখলে। আর একারণেই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। অর্থাৎ, কে জিতবে, পরাজয়ের গ্লানি হবে কার– বলা যাচ্ছে না এখনও। বর্তমানে এই যুদ্ধ রক্তক্ষয়, শক্তিক্ষয়ের এক সংগ্রামে রূপ নিয়েছে। উভয়পক্ষই সম্পদ ও জনবল দিয়ে লড়তে লড়তে, প্রতিনিয়ত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও, আগে শত্রুপক্ষ মাথা নোয়াবে এমন 'ওয়ার অব এট্রিশনে' লিপ্ত। তারই অংশ হিসেবে আকাশপথে ইউক্রেনের বৈদ্যুতিক গ্রিডে ক্ষেপণাস্ত্র ও আত্মঘাতী ড্রোন হামলা করছে রাশিয়া। আবার ভূমিতে কামানের গোলাবর্ষণ এবং 'হিউম্যান ওয়েভ' আক্রমণের মাধ্যমে ডনবাস অঞ্চলের বাখমুত দখলের দিকে এগোচ্ছে রুশ সেনারা।
আসছে বসন্তের লড়াই এই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাশিয়া দুই-তিন লাখ নতুন সেনা সমাবেশ করায়, ইউক্রেন রণাঙ্গনে জনবলে এগিয়ে থাকার সুবিধাটি হারাচ্ছে। রাশিয়া আরো বড় পরিসরে সেনা ভর্তির উদ্যোগও নিতে পারে। রাশিয়ার সমরাস্ত্র কারখানাগুলো তিন শিফটে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সচল রয়েছে। একইসময়, ফুরিয়ে আসছে পশ্চিমাদের কাছে ইউক্রেনকে দেওয়ার মতো গোলাবারুদ। ফলে কামানের গোলা বিনিময়েও পিছিয়ে পড়বে ইউক্রেন। এই বাস্তবতা উপলদ্ধি করেই, পশ্চিমা দেশগুলো মনে করছে, রাশিয়াকে সেনা প্রত্যাহার বা অন্ততপক্ষে শান্তি আলোচনায় ফিরতে বাধ্য করার জন্য ইউক্রেনের একটি 'গেম-চেঞ্জিং' কৌশল দরকার।
চলতি মাসে আমেরিকা ইউক্রেনকে যে দুটি বড় পরিসরের সামরিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে, তা এই আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্যাকেজ দুটির আওতায় আগের মতো ধাপে ধাপে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দিয়ে, পুরো ব্রিগেডকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করা হবে। এরই আওতায় ১০০টি ব্রাডলি ফাইটিং ভিহেক্যাল, ৯০টি স্ট্রাইকার ট্যাংক বিধ্বংসী যান, ১০০টি এম১১৩ আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারের মতো বিপুল পরিমাণ সাঁজোয়া যান দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাইডেন প্রশাসনের। এর মাধ্যমে মেকানাইজড ইনফেন্ট্রিসহ দুটি আর্মার্ড বা সাঁজোয়া ব্রিগেড গঠন করতে পারবে ইউক্রেন।
ইউরোপের মিত্ররাও বড় সংখ্যায় সাঁজোয়া যান পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। জার্মানি দিচ্ছে মার্ডার এএফভি, ফ্রান্স দিচ্ছে এএমএক্স-১০আরসি এএফভি/ লাইট ট্যাংক, আর সুইডেন ঘোষণা দিয়েছে সিভি-৯০ এএফভি দেওয়ার। ইউক্রেনীয়দের কাছেও আরো একটি বা দুটি ব্রিগেড গঠনের মতো সাঁজোয়া যান আছে, সব মিলিয়ে পশ্চিমা উপকরণ দিয়েই গঠন করা যাবে পুরো একটি ডিভিশন।
সাঁজোয়া ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো- স্বচালিত হাইউইটজার যান। এতে সাঁজোয়া বহরের আক্রমণ চলাকালেই তারা গোলাবর্ষণ করতে পারে। আমেরিকা এ ধরনের ১৮টি সেলফ প্রপেলড হাইউইটজার দেবে। অন্যদিকে, নিজদের মজুতে থাকা ফ্রান্সের তৈরি সিজার সেলফ প্রপেলড হাইউইটজারের সবগুলোই (১৯টি) দেবে ডেনমার্ক।
এ যেন ইউক্রেনের সাঁজোয়া শক্তিকে আপাদমস্তক নির্মাণের প্রচেষ্টা। 'কম্বাইন্ড আর্মস অপারেশনে' আমেরিকা ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। একেক বারে এক ব্যাটালিয়ন করে সেনাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে (সাধারণত তিন বা চার ব্যাটালিয়ন মিলে গঠিত হয় একেকটি ব্রিগেড)। কম্বাইন্ড আর্মস অপারেশনে কীভাবে সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, পদাতিক সেনা, ড্রোন, বিমানশক্তি ইত্যাদির সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হয় তা হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের।
আমেরিকার সামরিক বাহিনীর প্রধান চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মিলে বলেছেন, এসব সাহায্য 'রাশিয়ার আসন্ন আক্রমণ থেকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে। অধিকৃত অঞ্চল মুক্ত করতে ট্যাকটিক্যাল অপারেশনও পরিচালনা করতে পারবে তারা'।
তবে এই পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ হলো- বিপুল সংখ্যায় পশ্চিমা মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (এমবিটি) প্রদানের বিষয়টি – যেগুলো সাঁজোয়া আক্রমণের অগ্রভাগে থাকবে। ব্রিটেন মাত্র ১৪টি চ্যালেঞ্জার এমবিটি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা দিয়ে মাত্র একটি কোম্পানিকে সজ্জিত করা যাবে– ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের তো দূরস্থান। যেমন ব্রিটিশ একটি আর্মার্ড ব্রিগেডে থাকে ৫৬টি চ্যালেঞ্জার ট্যাংক; অন্যদিকে আমেরিকার একটি ব্রিগেডে থাকে ৮৭টি এম১ আব্রামস ট্যাংক।
জার্মানি সম্প্রতি ইউক্রেনকে লেপার্ড-২ এমবিটি দিতে রাজি হয়েছে। ডিজেল-ইঞ্জিন চালিত এ ধরনের প্রায় দুই হাজার ট্যাংক ইউরোপের বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে রয়েছে। ফলে এগুলো বিপুল সংখ্যায় তারা ইউক্রেনকে চাইলে দিতে পারবে। বার্লিন সম্প্রতি জানিয়েছে, পোলান্ডের মতো মিত্ররা জার্মানির তৈরি ট্যাংক পাঠাতে চাইলে- তারা এনিয়ে আপত্তি করবে না।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ট্যাংক খুব গুরুত্বপূর্ণ এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও, আসলে হয়তো তা নয়। ইউক্রেনের কাছে শত শত সোভিয়েত আমলের ট্যাংক রয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও এ ধরনের ট্যাংক দিয়েছে কিয়েভকে। আবার রুশ বাহিনীর থেকেও অনেক ট্যাংক দখল করেছে তারা। তারপরও গুণগত মানের প্রশ্নটা উঠতেই পারে। যেহেতু সুরক্ষা ও সক্ষমতার দিক দিয়ে পশ্চিমা ট্যাংকগুলো অধিক কার্যকর। তাই এগুলো না পেলে, সেই ঘাটতি ইউক্রেনকে পূরণ করতে হবে সোভিয়েত আমলের ভারী ট্যাংকের সাথে পশ্চিমা সাঁজোয়া যানের মিশ্র সমন্বয় ঘটিয়ে।
পশ্চিমা হালকা ধরনের সাঁজোয়া যানগুলোও মন্দ নয়, ১৯৯১ সালের ইরাক যুদ্ধে সোভিয়েত নির্মিত ট্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পায় ব্রাডলি। তাই ব্রিটিশ চিন্তক সংস্থা– রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস (রুসি) এর বিশেষজ্ঞ জ্যাক ওয়াল্টিং মতপ্রকাশ করেন যে, 'ইউক্রেনকে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পেলেই তারা দ্রুত শক্তিশালী একটি আর্মার্ড ফোর্স গঠন করতে পারবে। তারা শত্রুর আঘাত সামলে, ব্রেক থ্রু অপারেশনও পরিচালনা করতে পারবে'।