ইউক্রেনে বসন্তকালীন অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া
ইউক্রেনে চলমান লড়াইয়ের চরিত্রকে প্রায়ই প্রথম মহাযুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয়। ব্যাপক সেনা সমাবেশ, তুমুল গোলাবর্ষণ এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিখার যুদ্ধের এসব বৈশিষ্ট্য মহাযুদ্ধের সময়েও দেখা গেছে, যার একমাত্র লক্ষ্যই হলো বিপক্ষের শক্তিক্ষয়। খবর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের
এদিকে শীত শেষ হওয়া মাত্রই রাশিয়ার বসন্তকালীন আক্রমণ অভিযান শুরু হবে বলে দীর্ঘদিন ধরে অনুমান করা হচ্ছে। এই অভিযান যখন শুরু হবে, তার সাথে প্রথম মহাযুদ্ধের মিল হয়তো কমই হবে। অর্থাৎ, বিগত মহাযুদ্ধের মতো রুশ সেনারা পরিখা ছেড়ে শত্রুর দিকে অগ্রসর হবে না। আক্রমণ আসবে অপ্রত্যাশিতভাবে এবং একাধিক দিক দিয়ে। রাশিয়া এপর্যন্ত যেসব রণকৌশল ব্যবহার করেছে, এটা হবে তার চেয়ে ব্যতিক্রম। আরো বেশি ভূমিকা থাকবে বিমানশক্তির। এমন সব সতর্ক বার্তাই দিচ্ছেন সামরিক কর্মকর্তারা।
পশ্চিমা একজন সামরিক কর্মকর্তা বলেন, 'রাশিয়ার আক্রমণ সম্ম- এর (মহাযুদ্ধকালের একটি যুদ্ধাভিযান) মতো হবে না… এটা ভিন্নভাবে পরিচালিত হবে, সম্মুখভাগের বিভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এই অভিযানকে কোনো একক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না আমাদের'।
ইউক্রেনের কিছু অংশে এরমধ্যেই আক্রমণ অভিযান শুরু হয়েছে। ইউক্রেনের স্পেশাল ফোর্সের একজন কর্মকর্তা তারাস বেরেজোভেৎস বলেন, 'রাশিয়ান আক্রমণ শুরু হয়েছে সপ্তাহখানেক আগেই। এই অভিযানে আরো রুশ সেনা সম্পৃক্ত হবে বলেই আমাদের ধারণা'।
মূল আঘাত হানার আগে ফ্রন্টলাইনের কোথায় শত্রুর প্রতিরোধ শক্তি কেমন- তা যাচাই করতে বিক্ষিপ্ত হামলা পরিচালনা করা হয়, সামরিক পরিভাষায় যাকে বলে 'প্রোবিং অ্যাটাক'। এরমধ্যেই উত্তরে ক্রেমিন্না এবং দক্ষিণে ভহলেদারের কাছে এ ধরনের হামলা করছে রুশ বাহিনী। গত বছরের গ্রীষ্মের পর আবারো সর্বোচ্চ হারে গোলা নিক্ষেপ শুরু করেছে রাশিয়ান গোলন্দাজ ইউনিটগুলো। দিনে অন্তত ১০০ বার আর্টিলারি স্ট্রাইক আঘাত হানছে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর বসন্তের অফেন্সিভ-ই হতে পারে ক্রেমলিনের প্রথম বড় অভিযান। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে আক্রমণ অভিযানের জন্য দরকারি সব ধরনের সরঞ্জাম মোতায়েনের কোনো প্রমাণ এপর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
তবে মাঠপর্যায়ে যুদ্ধ প্রস্তুতিরই ছায়া দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, রাশিয়া ফাইটার জেট, বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার মোতায়েন শুরু করেছে স্থল আগ্রাসনকে বিমানশক্তির সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে।
ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের কাছে নতুন সেনা ছাউনি স্থাপন করেছে মস্কো। এক বছর আগে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর আগেও ঠিক এ জায়গায় তারা সেনা সমবেত করেছিল।
সামরিক পরামর্শক সংস্থা রোচান কনসাল্টিং এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকা বলেন, 'আমাদের ধারণা এসব ছাউনিতে রিজার্ভিস্ট সেনাদের রাখা হয়েছে। এটা তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি মোতায়েনের প্রাথমিক পদক্ষেপ, এই প্রথম যার প্রমাণ মিললো। এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, অচিরেই তাদের ইউক্রেনে নিয়ে আসা হবে। ফলে আক্রমণের তীব্রতা বাড়বে'।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য উত্তর দিক থেকে হাজার হাজার সেনা পাঠানো, যারা দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হওয়া রুশ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল পুরোপুরি দখলে নেবে।
কিয়েভ-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- ইউক্রেনিয়ান সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন সেন্টারের চেয়ারম্যান সেরহি কুজান বলেন, 'এই লক্ষ্য অর্জনের ভার জেনারেল গেরাসিমভকে (ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক) দিয়েছেন পুতিন। এই বাস্তবতায়, আমাদের দায়িত্ব হলো প্রতিরক্ষা লাইনকে রক্ষা করা এবং শত্রুর আক্রমণ চালানোর শক্তি ক্ষয় করে তা নিঃশেষিত করা'।
এখন পর্যন্ত সফলভাবে প্রতিরোধ সারি রক্ষা করেছে ইউক্রেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে ভহলেদারের কাছাকাছি এলাকায়। মস্কো গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবহন হাব দখল করতে চায়, কারণ তাতে করে ক্রিমিয়ার সাথে রাশিয়াকে যুক্তকারী ভূখণ্ডকে নিরাপদ রাখা যাবে।
গত কয়েকদিনে ইউক্রেনীয়দের ওপর হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনীর অভিজাত কিছু ইউনিট। কিন্তু, প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদের আক্রমণ চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। এখনও বাখমুতে লড়ে চলেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী, উভয়পক্ষেই ঘটছে বিপুল হতাহতের ঘটনা।
চিন্তক সংস্থা র্যান্ড- এর জ্যেষ্ঠ নীতি গবেষক দারা ম্যাসিকট বলেন, 'পুতিন এখন অধৈর্য। তিনি ন্যূনতম পরিমাণ হলেও অর্জন চান যুদ্ধের ময়দানে। তার অনুগতরা একবাক্যে তাতে সায় দেবে। লক্ষ্য অর্জনে তিনি প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করছেন… এই কৌশলের জন্য তাদের মূল্য দিতেও হচ্ছে'।
যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবমতে, গত এক বছরে অন্তত ২ লাখ রুশ সেনা আহত বা নিহত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪ হাজার সেনা হতাহত হয়েছে, মাসিক হিসাবে যা ১৭ হাজার।
এই হারে চলতে থাকলে রাশিয়া যে ৩ লাখ নতুন সেনা সমবেত করেছে, তাদের দিয়ে মাত্র ১৭ মাস যুদ্ধ চালাতে পারবে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের ভিজিটিং ফেলো মাইক মার্টিন বলেন, হতাহতের সংখ্যা ৩০ শতাংশ হলেই কমব্যাট ইউনিটকে অকার্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই হিসাবে, রিজার্ভ সেনারা আরো কম সময় টিকতে পারবে।
তার মতে, 'এসব কৌশলে ইউক্রেন দখল করতে পারবে না রাশিয়া'।
সেরহি কুজান বলেন, মোবিলাইজড রাশিয়ান সেনাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জা অনেকটাই কম সেইসব সেনাদের চেয়ে যারা গত বছরে ইউক্রেনে আক্রমণ করেছিল। 'তাদের সক্ষমতার মাত্রা অনেক অনেক নিম্ন'।
একারণেই বসন্তকালীন অভিযান শুরু হলে– রাশিয়া তার সেনাদের জীবনের প্রতি বেপরোয়া মনোভাব পরিত্যাগ করবে বলে মনে করেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। এক কর্মকর্তা বলেন, 'এখন পর্যন্ত রুশ সেনাবাহিনী যতোটা বাজে প্রদর্শন করেছে, ততোটা আর থাকবে না। তারা ভুল থেকে শিখে আরও উন্নত হবে এটা প্রায় অবধারিত'।
আরেকটি পরিবর্তন হবে রাশিয়ান বিমান বাহিনীর ভূমিকা। রুশ বিমানশক্তির ৮০ শতাংশ এপর্যন্ত অপারেশন পরিচালনার মতো সবল অবস্থানে; পশ্চিমা গোয়েন্দারা মনে করছেন, এসব জেট ও হেলিকপ্টার যুদ্ধে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, 'যতোটা প্রত্যাশিত ছিল সেই পরিসরে এপর্যন্ত রুশ বিমান বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়নি। আগামী মাসগুলোয় যুদ্ধাঞ্চলের আকাশে তাদের উপস্থিতি আরো বেশি বেশি দেখতে পাব আমরা'।
আপাতত, পূর্ব ইউক্রেনের আবহাওয়া পূর্ণদ্যমে আক্রমণ অভিযানের অনুকূল নয়। তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে গেলে জমাট বাধে মাটি, তখন অভিযান পরিচালনা সহজ হয়। চলতি সপ্তাহেই তাপমাত্রা সে হারে কমবে বলে এর আগে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পরে জানানো হয় তাপাঙ্ক শূন্য ডিগ্রীর উপরেই থাকবে। এতে মাঠগুলো পরিণত হবে কাদার সাগরে, যার বুক চিরে সামরিক যান চলাচল কষ্টসাধ্য, এতে যে দেরি হয় তাতে শত্রুকে চমকে দেওয়ার সুযোগও হারায় আক্রমণকারী বাহিনী।
তবে বসন্ত শুরু হলেই রাশিয়া পূর্ণদ্যমে আক্রমণে যাবে, তুষার ও কাদা কোনোটারই উপদ্রুপ তখন থাকবে না। এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে উভয় পক্ষই আগামী দিনের প্রচণ্ড ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাশিয়ার ওয়াগনার মার্সেনারী গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন গত সপ্তাহে বলেন, ডনবাস দখলে নিতে রাশিয়ার 'দেড় বা দুই বছর লাগবে'।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, 'সামনে অনেক কঠিন সপ্তাহ অপেক্ষা করছে, কখনো ইউক্রেন অগ্রসর হবে, কখনোবা পিছু হটতে হবে তাদের। ইউক্রেনীয়দের জন্য চলতি বছর দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের এক সময় হতে পারে'।