রহস্যময় জাহাজ বহর বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে সাহায্য করছে, বহর আরো বড় হচ্ছে
ইচ্ছুক ক্রেতাদের কাছে জ্বালানি তেল পৌঁছে দিতে পারছে রাশিয়া। এই বাণিজ্য এতোটা সঙ্গোপনে চলছে যে মহাসমুদ্রজুড়ে রাশিয়ান তেল পরিবহনকে যারা অনুসরণ করেন, সেসব বিশেষজ্ঞ ও সংস্থাও কূল পাচ্ছে না যে আসলে কারা বহন করছে। খবর সিএনএনের
ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর থেকেই মস্কোর বিরুদ্ধে বেড়েছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। এরমধ্যেই রাশিয়ার তেল রপ্তানিকে সুগম করতে, দেশটির বিদ্যমান গোপন ট্যাংকার বহরের সাথে যোগ দিয়েছে আরো অনেক জাহাজ।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরীণদের অনুমান, এই ছায়াবহরে প্রায় ৬০০ জাহাজ রয়েছে, যা বিশ্বের বৃহৎ ট্যাংকার জাহাজের মোট সংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। দিন দিন এই সংখ্যা আরও বেড়েই চলেছে।
এই জাহাজগুলোর মালিকানা সংস্থা কারা বা কাদের দ্বারা পরিচালিত– সেটা এখনও এক ধাঁধা। কারণ, গত এক বছরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার তেল বাণিজ্য বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। এসময়ে অনেক পশ্চিমা কোম্পানিই রাশিয়ান চালান বহন থেকে সরে এসেছে। এই সুযোগে গোপন সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা বেড়েছে, যাদের প্রকৃত মালিকানা নিয়ে আছে অস্পষ্টতা। যেমন অনেক ক্ষেত্রেই দুবাই বা হংকংয়ে ছদ্ম শিপিং কোম্পানি গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইউরোপ থেকে পুরোনো জাহাজ কিনেছে। অন্যরা আবার ব্যবহার করছে পুরোনো এবং বাতিল হওয়ার যোগ্য এমন জাহাজ, নাহলে যেগুলোর অবধারিত ঠিকানা হওয়ার কথা ছিল স্ক্র্যাপইয়ার্ড।
অস্পষ্ট এই পরিবহন নেটওয়ার্কের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তেল বাণিজ্যে জড়িত একটি সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, 'অন্ধকার এই দুনিয়াটা আপনাকে আরো গভীরে তলিয়ে দেখতে হবে'।
বিশ্বের শিপিং কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় নিভৃতে চলাচলকারী এসব জাহাজের বহর মস্কোর কাছে দিন দিন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষত, যখন পশ্চিমা আমদানিকারকদের বদলে চীন ও ভারতের ক্রেতারা হয়ে উঠছে রপ্তানির প্রধান গন্তব্য।
আগে রাশিয়ার জ্বালানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা ইউরোপ হলেও, এখন সমুদ্রপথে রপ্তানিকৃত অপরিশোধিত রাশিয়ান তেল (ক্রুড অয়েল) ও পরিশোধিত ডিজেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগেই এ পদক্ষেপ নেয়।
ফলে চীন ও ভারতের রিফাইনারিগুলোতে চালান পৌঁছানো মস্কোর কাছে আরো গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ এশিয়াই বর্তমানে রাশিয়ান তেলের ইউরোপীয় চাহিদাকে প্রতিস্থাপন করছে। কিন্তু, জি-৭ জোট রাশিয়ান তেল বিক্রিতে মূল্যসীমা বেঁধে দেওয়ায়- এই বাণিজ্যে রয়েছে আইনি ঝুঁকিসহ নানান জটিলতা।
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজারে যেসব নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে, তারমধ্যে অন্যতম এই ছায়াবহর সম্প্রসারিত হওয়ার ঘটনা। বাণিজ্য বাধামুক্ত রাখতে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্রুড অয়েল রপ্তানিকারক রাশিয়া কয়েক দশক ধরে চলে আসা এই বাণিজ্যের অনেক কাঠামোকে পরিবর্তন করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে এই বিরোধের ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থাও দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক শিপ ব্রোকারেজ ইএ গিবসন- এর প্রধান গবেষক রিচার্ড ম্যাথিউস বলেন, ' দুই ধরনের বহর রয়েছে। একদল রাশিয়ার সাথে কোনো ব্যবসাই করছে না। আরেক পক্ষ আবার শুধু রাশিয়ার সাথেই ব্যবসা করছে'। সে তুলনায়, অল্প কিছু সংখ্যক জাহাজই উভয় ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
'গ্রে শিপ' ও 'ডার্ক শিপ'
ইউরোপ যখন রাশিয়ান জ্বালানি থেকে পিছু হটছিল, তখনই চুক্তি করতে এগিয়ে আসে এশীয় ক্রেতারা। ২০২২ সালে দৈনিক গড়ে ১৯ লাখ ব্যারেল রাশিয়ান তেল আমদানি করেছে চীন। ২০২১ সালের চেয়ে আমদানি বেশি হয় ১৯ শতাংশ। এসব তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)।
চীনের চেয়ে আরো জোর গতিতে রাশিয়ান তেল কেনা শুরু করে ভারত। ২০২২ সালে ভারত প্রতিদিন ৯ লাখ ব্যারেল রাশিয়ান তেল কিনেছে। আগের বছরের চেয়ে যা ৮০০ শতাংশ বাড়ে।
তথ্যবিশ্লেষক কোম্পানি কেপলার জানায়, জাহাজে পরিবহন করা রাশিয়ান তেল কেনার ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর– চীন ও ভারত উভয় দেশেই রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায় রাশিয়ার তেল রপ্তানি। আরেক শীর্ষ ক্রেতা তুরস্কেও একইভাবে তা বেড়েছে।
নতুন এসব ক্রয়াদেশ পূরণে দরকার ছিল বাড়তি জাহাজের। কারণ, রাশিয়ার জাতীয় বাণিজ্য বহরে পর্যাপ্ত ট্যাংকার জাহাজ নেই। এই ঘাটতি পূরণেই ছায়াবহরের সুবিধা দিতে এগিয়ে এসেছে নতুন অনেক শিপিং কোম্পানি।
রাশিয়ান ক্রুড অয়েল বহনকারী জাহাজগুলোকে দুই শ্রেণি: 'গ্রে শিপ' ও 'ডার্ক শিপ'- এ ভাগ করেছেন কেপলারের জ্যেষ্ঠ ফ্রেইট বিশ্লেষক ম্যাথু রাইট। যেসব জাহাজকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মালিকরা বিক্রিরা করেছেন সেগুলো হলো 'গ্রে শিপ'। এসব জাহাজ আগে ট্যাংকার বাণিজ্যে জড়িত ছিল না, তারা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, 'ডার্ক শিপ' বলা হচ্ছে সেসব জাহাজকে, যেগুলো এর আগে ইরান ও ভেনেজুয়েলা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে জ্বালানি রপ্তানিতে ব্যবহার করেছে। নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে এসব জাহাজের ক্রুদের। তারা এখন রাশিয়ান তেল বহন করছে।
বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এআইএস ট্রান্সপন্ডারের নামক যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের অবস্থানের জানান দেয়। রাইট বলেন, "এই যন্ত্র ডার্ক শিপগুলো প্রায়ই বন্ধ রাখছে'। ফলে তাদের চিহ্নিত করা বা গতিবিধির ওপর নজর রাখা সহজ নয়।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের জন্য রাশিয়ান তেল আমদানি নিষিদ্ধ করলেও, চীন বা ভারতের মতো ক্রেতাদের কাছে পশ্চিমা জাহাজ ব্যবহার করে চালান পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ দেয়নি। জি-৭ নির্ধারিত মূল্যসীমা মানলে- চালানের বিমা করতেও নেই কোনো বাধা। কেপলার জানিয়েছে, গত জানুয়ারিতে ইউরোপীয় মালিকানায় থাকা জাহাজগুলো মোট রাশিয়ান ক্রুড বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশ বহন করেছে।
যদিও মূল্যসীমা মেনে এই বাণিজ্য করতে হয়, যাতে ঘোর আপত্তি আছে রাশিয়ার। মস্কো চেষ্টা করছে, পশ্চিমা শিপিং কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে। আর সে উদ্যোগ থেকেই নতুন এমন সংস্থার সাথে চুক্তি করছে, যাদের পরিচয় অস্পষ্ট, অতীতও বিতর্কিত।
জ্বালানি বাণিজ্যের পরামর্শক সংস্থা- রিস্টাড এনার্জির জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জানিভ শাহ বলেন, 'যুদ্ধ শুরুর পর- বিশ্বব্যাপী ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল বহনকারী ডার্ক ফ্লিটের পরিসর বাড়বে বলে আমরা ধারণা করেছিলাম, আর সেটাই হয়েছে'।
এর আরেক কারণ দূরত্ব। রাশিয়ার জন্য ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের কাছে তেল বিক্রি করা ছিল সহজ এবং সাশ্রয়ী। সে তুলনায়, ভারত ও চীনের মতো গন্তব্য অনেক দূরের পথ। অধিক দূরত্বে চালান নিতে এখন রাশিয়ার চারগুণ বেশি শিপিং সক্ষমতা দরকার বলে জানাচ্ছে ইএ গিভসন।
ফলে প্রতিমাসে রাশিয়ার ছায়াবহরের জন্য ২৫-৩০টি নতুন জাহাজ বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তেল বাণিজ্যের আরেকটি সংস্থার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী।
গ্লোবাল উইটনেস নামক একটি অলাভজনক সংস্থার হিসাবমতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি হওয়া তেলবাহী ট্যাংকারের এক-চতুর্থাংশ অজ্ঞাত বিক্রেতাদের মাধ্যমে হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা বাড়ে দ্বিগুণ হারে।
এদিকে চীনের অর্থনীতি উন্মুক্ত হওয়ায়, সেখানে জোরালো চাহিদার আশা করা হচ্ছে। এতে করে, দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আরো বেশি জ্বালানির প্রয়োজন হবে। আর রাশিয়ান তেল বাণিজ্য তাতে আরো চাঙ্গা হবে এমন আশঙ্কা করছে পশ্চিমা বিশ্ব।