ইরাকে বিশ বছর ধরে প্রচার করা মার্কিন গণতন্ত্র যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে
২০০৩ সালে ইরাক হামলাকে বিভিন্নভাবে ন্যায্য হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং তার প্রশাসন।
অভিযানের কয়েক মাস আগে বুশ ঘোষণা দিয়েছিলেন এই দ্বন্দ্বের উদ্দেশ্য কেবল সন্ত্রাস নির্মূল করা এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করাই নয়; মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে অংশগ্রহণমূলক সরকারব্যবস্থার অভাবের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এর উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রও ফিরিয়ে আনা।
এই লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যের দাবিগুলোর সবগুলোই পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৪ সালে তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট কলিন পাওয়েল স্বীকার করেছিলেন, 'আমাদের তথ্যসূত্র ভুল ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল পথে পরিচালনা করা হয়েছে।'
বাস্তবে পাওয়েল আর তার সহযোগীদের দাবি করা কোনো 'গণবিধ্বংসী অস্ত্র'ই ইরাকের কাছে মজুদ ছিল না। তবে এই দাবি ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত ও গণতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্য গঠনের দিকে জোর দিয়েছে। ২০০৩ সালে বুশ মার্কিন জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, "ইরাকের নতুন শাসনব্যবস্থা ঐ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের জন্য এক নাটকীয় ও অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ হিসেবে টিকে থাকবে।"
এক লক্ষ মার্কিন সৈন্য এবং তাদের অন্যান্য মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত বাহিনীর সামনে তুরুপের তাসের মতো সাদ্দাম হোসেনের ইরাকি বাহিনী ভেঙে পড়ার সময় বুশ সবার মনোযোগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে জোর দেন। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে বুশ ঘোষণা করেন, "মধ্যপ্রাচ্যের ঠিক কেন্দ্রে একটি মুক্ত স্বাধীন ইরাক প্রতিষ্ঠা সারাবিশ্বে এক গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার তৈরি করবে।" 'মধ্যপ্রাচ্যের মুক্তি'র জন্য যুক্তরাষ্ট্র 'প্রত্যক্ষ কৌশল' কার্যকরী থাকবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
বিশ বছর পর এসে এখন হিসাব করার পালা এই 'প্রত্যক্ষ কৌশল' ইরাক এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকরী হয়েছে। ২০০৩ সালে, বুশ যেরকমভাবে দাবি করেছিলেন, ঠিক সেভাবে বাস্তবেই 'গণতন্ত্রের অভাব' ছিল, যেখানে বেশিরভাগ দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেলেও ঘুরেফিরে সেই কর্তৃত্ববাদিতাই টিকে রয়েছে।
'স্বাধীনতা ব্যবধান'-এর পরিমাপ
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বিভিন্নভাবে একটি দেশ কতটুকু গণতান্ত্রিক আর কতটুকু কর্তৃত্ববাদী তা পরিমাপের চেষ্টা করেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজকেই, যারা কার্যকরী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অবাধ ও সুষ্ঠূ নির্বাচনের পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো জনগণের নাগরিক অধিকার এবং স্বাধীনতার বিষয়গুলো পরিমাপ করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পর্কে রায় দেয়। ফ্রিডম হাউজ এরপর ২ (সবচেয়ে স্বাধীন) থেকে ১৪ (সবচেয়ে কম স্বাধীন) স্কেলের মাধ্যমে একটি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নির্ধারণ করে।
আরব অঞ্চলের তৎকালীন সময়ের গণতন্ত্র নির্ধারণের একটি উপায় হতে পারে উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে লোহিত সাগর এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ২৩টি আরব দেশ নিয়ে তৈরি আরব লীগের দেশগুলোর গড় ফ্রিডম হাউজের স্কোর। ২০০৩ সালে আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর গড় স্কোর ছিল ১১.৪৫, যেখানে সারাবিশ্বের গড় ছিল ৬.৭৫। অর্থাৎ, সারাবিশ্বের হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য ছিল অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী। ২০০৩ সালে ফ্রিডম হাউজ ৪৬%-এর বেশি স্কোর করলেই দেশটিকে 'গণতান্ত্রিক' অ্যাখ্যা দিলেও আরব লীগের কোনো দেশই সেই স্কোরও পূরণ করতে পারেনি।
তখন সৌদি আরবের মতো কয়েকটি দেশ রাজতন্ত্রের মাধ্যমে শাসিত হলেও লিবিয়ার মতো দেশ চালিত হচ্ছিলো স্বৈরাচারী শাসকদের মাধ্যমে।
৩০ বছর ধরে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক শাসন পড়ে দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতেই। পুরো আরব বিশ্বকে একটি জাতিতে পরিণত করতে চাওয়া রাজনৈতিক দল বাথ পার্টির ১৯৬৮ সালের ইরাক অভ্যুত্থানের অংশ থাকা সাদ্দাম মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যেও পরিচিত ছিলেন। ইরাকের তেল সম্পদ আর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর দমনমূলক কৌশল খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শাসন করে আসছিলো বাথ পার্টি।
২০০৩ সালের এপ্রিলে সাদ্দামের পতন তার তুলনায় কিছুটা গণতান্ত্রিক শাসকদেরকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ইরাকে আট বছর ধরে চলা গোষ্ঠীগত বিবাদের পর মার্কিনরা এক দুর্বল আর বিভিন্ন ভাগে বিভাজিত ইরাককেই রেখে গিয়েছে।
আক্রমণ-পরবর্তী ইরাক
২০০৩ সালে ইরাকের 'অগণতান্ত্রিক' শাসকগোষ্ঠীকে টেনে নামালেও সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। ইরাকের মূল তিন গোষ্ঠী: সুন্নী, শিয়া এবং কুর্দিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পুরো দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ঢেলে সাজানোর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যদিও ইরাকের এখন সংবিধান রয়েছে এবং নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তারপরেও ইরাকের গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই, এমনকি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাদান নিশ্চিত করার মতো অধিকার পূরণ করতেও দেশটিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এবং এ কারণেই ২০২৩ সালে এসেও ইরাক ফ্রিডম হাউজের স্কোরিংয়ে 'স্বাধীন নয়' হিসেবেই মূল্যায়িত হয়েছে।
২০১১ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্যদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ইরাক একের পর এক রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইরাকের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল চরমপন্থী গোষ্ঠী আইসিস।
দুর্নীতির কারণে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ইরাকে একের পর এক সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলেও সেগুলোকে শক্ত হাতে দমিয়ে দেয় ইরাক সরকার। এই আন্দোলনের পর ২০২১ সালের নভেম্বরে আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখনো সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে কোনো জোটবদ্ধ সরকার গঠন করতে পারেনি তারা।
যদিও ইরাকের সাম্প্রতিক এই সংকট থেকে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা ছিল, তারপরও সেটি থেকে দূরে থেকেছে তারা। তবে ইরাকের রাজনৈতিক দলগুলোর সামরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার ঝুঁকি এখনো রয়ে গিয়েছে।
আক্রমণ-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য
ইরাক গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ডুবে রয়েছে। এবার মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের 'গণতন্ত্র' ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেদিকে নজর দেওয়া যাক।
২০১৪ সালের মধ্যে আরব বসন্তের কারণে আরব বিশ্বের দেশগুলোতে হওয়া একের পর এক গণআন্দোলনে পতন ঘটে তিউনিশিয়া, মিশর, ইয়েমেন এবং লিবিয়ার স্বৈরশাসকদের। মরক্কো এবং জর্ডানের মতো রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলোতেও রাষ্ট্রপ্রধানরা জনগণের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হয়, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং মন্ত্রী পরিবর্তনের মতো বিষয়।
তারপরেও আরবাঞ্চলে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ টিকিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। মিশরে সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতায় এসে আবারো দেশটিকে কর্তৃত্ববাদীদের কব্জায় নিয়ে গিয়েছে। ইয়েমেনে রাজনৈতিক শূন্যস্থানের ফলাফল হয়েছে দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধ।
২০২৩ সালে এসে আরব লীগের দেশগুলোর ফ্রিডম হাউজের গড় স্কোর ১১.৪৫, দুই দশক আগে ইরাক যুদ্ধের আগে যা ছিল, ঠিক তা-ই।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রচার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে আরও দ্রুত করেছে নাকি ধীর করেছে তা বলা কঠিন। এবং অন্য কোনো পদ্ধতি আরও ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারতো কিনা, সেটিও বলা সহজ নয়। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে, মধ্যপ্রাচ্যে 'গণতন্ত্রের অনুপ্রেরণা'র উদাহরণ হিসেবে ইরাক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সূত্র: এশিয়া টাইমস