রাশিয়ার দুর্গসম ফ্রন্টলাইন ভেদ করতে ইউক্রেনের ‘উচ্চঝুঁকি’র বসন্ত অভিযান
একদিকে পশ্চিমা ট্যাংকসমৃদ্ধ ইউক্রেনের ৩৫ হাজার সৈন্য। তারা দীর্ঘ ৯৫০ কিলোমিটার ফ্রন্টলাইনে এক লাখ ৪০ হাজার রুশ সেনার মুখোমুখি হবে। আর দুই পক্ষের মাঝখানে আছে মাইনফিল্ড, পরিখা ও ট্যাংক থামানোর জন্য বসানো প্রতিবন্ধকতা।
সামনের বসন্তকালীন অভিযানে ফ্রন্টলাইনে রুশ দুর্গ ভেঙে এগিয়ে নিজেদের হারানো ভূমি পুনর্দখলের চেষ্টা করবে ইউক্রেন। আর এ অভিযানের প্রথম ধাপে বিপুল ঝুঁকি নিতে হবে ইউক্রেনকে। এ আক্রমণে ইউক্রেনের জয় বা ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতি কেমন হবে অথবা মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় বসার সময় কতটুকু শক্তি নিয়ে আলোচনা চালাতে পারবে কিয়েভ। বিশ্লেষণ দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর।
সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ যুদ্ধে বিস্তর কাঠখড় পোহাতে হবে ইউক্রেনকে। শত্রুব্যূহ ভাঙার কাজটি অবিশ্বাস্যরকমের কঠিন। কারণ এর জন্য আর্টিলারি থেকে শুরু করে ট্যাংক, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ থেকে প্রকৌশল — সব ধরনের সামরিক ইউনিটকে একসঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়।
তার সঙ্গে ইউক্রেনের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে আকাশ থেকে দেশটির আক্রমণ চালানোর সক্ষমতার অভাব। সর্বশেষ বড় কোনো যুদ্ধে পশ্চিমা ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী সোভিয়েতযুগের টি-৭২ ট্যাংকে সজ্জিত ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তখন মিত্রবাহিনী ভূমিতে আক্রমণকারী যুদ্ধবিমান ও অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সহায়তা পেয়েছিল।
ভূমিতে আক্রমণ পরিচালনার জন্য ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমাদের সরবরাহ করা বিভিন্ন ভারী অস্ত্র ব্যবহার করবে। এসবের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেনের চ্যালেঞ্জার ট্যাংক, জার্মানির লেপার্ড ট্যাংক, আমেরিকার ব্র্যাডলি ফাইটিং ভেহিকল এবং সেল্ফ-প্রপেল্ড আর্চার হাউইটজার।
কিন্তু আকাশে পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না থাকায় রাশিয়ান যুদ্ধবিমানগুলো খুব সহজেই ইউক্রেনের বিশেষায়িত প্রকৌশল যানগুলোকে ধ্বংস করতে পারবে। এখন পর্যন্ত পশ্চিমারা ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করতে কিয়েভের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ব্রিটিশ আর্মার্ড ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন-এর সাবেক কমান্ডার বেন ব্যারি বলেন, ভূমিতে 'আক্রমণের উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো শত্রুকে এক বা একাধিক জায়গায় পেছন থেকে আক্রমণ করা এবং শত্রুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে মুহুর্মুহু আক্রমণ চালানো।' তবে ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুরের যুদ্ধে মিশরীয় অবস্থানের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর ভূমিতে আক্রমণের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিমানবাহিনীর পর্যাপ্ত সক্ষমতা ছাড়া এ ধরনের অভিযানের সফলতা খুবই বিরল বলেও জানান তিনি।
এ কথা এখন স্পষ্ট যে ইউক্রেন শীঘ্রই রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ চালাবে। সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ইউক্রেনীয় সেনারা বিভিন্ন ব্রিটিশ অস্ত্র পরিচালনা করা শিখছেন। ওই ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিল: 'কিসের জন্য? আপনারা দেখবেন।' সঙ্গে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লেখা হয়, স্প্রিংইজকামিং (বসন্ত আসছে)।
আগামী মে মাসের মধ্যে ইউক্রেনের ভূমির গঠন শক্ত হয়ে যাবে। তখন এসব ভুমিতে তখন পশ্চিমা ভারী সাঁজোয়া যানগুলো অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। ঠিক কোন জায়গায় ইউক্রেন হামলা করবে, স্বাভাবিকভাবেই তা গোপন রেখেছে দেশটি। রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হচ্ছে আজভ সাগরের কাছে মেলিতোপল এলাকা। এখানে ইউক্রেন সফলভাবে হামলা চালালে রাশিয়ান বাহিনী দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু রাশিয়াও কোনো ঝুঁকি নেয়নি, বাড়িয়ে তুলেছে এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষা।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে মাইনফিল্ড স্থাপন, তার পেছনে ড্রাগন'স টিথ নামক পিরামিড আকৃতির কংক্রিটের বাধা। এরপর আরেকটি মাইনফিল্ড, পরিখার সারি, এবং আরও ৪০০ মিটার পেছনে খুঁড়ে রাখা গর্ত। পরিশেষে ৫০০ মিটার পেছনে ট্যাংক থামানোর জন্য মাটির ওপর গর্তের ফাঁদ।
তবে ইউক্রেন যেখানেই আক্রমণ শুরু করুক না কেন, এ আক্রমণের প্রথম ধাপ হলো মাইনফিল্ড পরিষ্কার করা। ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি বিস্ফোরকভর্তি পাইপকে পাঁচ মিটার প্রশস্ত মাইনফিল্ডের ওপর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এ বাধা অতিক্রম করবে দেশটি।
এর পরের ধাপ হলো ড্রাগন'ন টিথের বাধা অতিক্রম করা। ট্যাংকের সঙ্গে লাঙলের ফলার মতো বস্তু জুড়ে দিয়ে এ বাধা পেরুবে ইউক্রেন। আর সর্বশেষ ধাপে নির্দিষ্ট প্রকৌশল সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিভিন্ন পরিখা, গর্ত পার হবে ইউক্রেনীয় সেনারা।
ব্রিটেনের রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সাবেক কর্মকর্তা নিক গানেল বলেন, 'পুরো ব্যাপারটাই মোমেন্টাম ও দ্রুতির ওপর নির্ভর করেব। কিন্তু অনেক কিছুই পরিকল্পনামাফিক হবে না, তাই সে সবের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।'
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ অভিযানের সবচেয়ে কঠিন ধাপটি হচ্ছে সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন অংশের কাজের ছন্দ মেলানো। ছোট পরিসরে যুদ্ধের পর্যাপ্ত দক্ষতা থাকলেও বসন্তকালীন অভিযানের মতো এত বড় পর্যায়ের অভিযানের ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অভিজ্ঞতা এখনো সীমিত।
এছাড়া ইউক্রেনীয় বাহিনীগুলো তাদের অভিজ্ঞ সেনাদের একটি বড় অংশকেই চলমান যুদ্ধে হারিয়েছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধবিষয়ক মার্কিন গোপন গোয়েন্দা নথিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের এ পাল্টা আক্রমণ কিয়েভের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হতে পারে।
তবে ইউক্রেনের সক্ষমতাকে এর আগেও ছোট করে দেখার নজির আছে। অতীতে পশ্চিমা সামরিক মূল্যায়নকে ভুল প্রমাণ করে ইউক্রেন কিয়েভ ও খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। পশ্চিমাদের ধারণা অনুযায়ী, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি সৈন্য হারিয়েছে। আর রাশিয়ান বাহিনীর চেয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী অধিকতর সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত।