ইউক্রেনের আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়ার ৮০০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা লাইন, পারবে ইউক্রেন ভেদ করতে!
৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্রন্টলাইন জুড়ে পরিখা, ট্যাংক-বিরোধী গর্ত, ড্রাগন'স টিথ তথা শক্তিশালী কংক্রিটের ব্লক, কংক্রিটের তৈরি মেশিন গান নেস্ট, ও বাংকার; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ প্রথম আবারও এমন দৃশ্য দেখল ইউরোপ। গত বছর ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে এ প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে রেখেছে। আর অন্যদিকে এ ধরনের বাধা অতিক্রম করতে বিশেষভাবে নকশা করা ভারী অস্ত্রের সরবরাহ বাড়িয়ে তুলছে কিয়েভের পশ্চিমা মিত্ররা।
গত গ্রীষ্মে কিয়েভ সফলভাবে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে খারকিভ ও খেরসনে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু এবারের বসন্ত অভিযানে তুলনামূলক অনেক বেশি সৈন্য, ট্যাংক ও এয়ার সাপোর্টের দরকার হবে ইউক্রেনের।
ওই সময় রাশিয়ান আর্মি পিছু হটছিল বলে তাদের পক্ষে কোনো রক্ষাব্যূহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাই ছোট ছোট সেনাদল ও হালকা সাঁজোয়া যান নিয়ে ইউক্রেন খুব সহজেই রাশিয়ান অবস্থানে হামলা করে কাবু করতে পেরেছিল। কিয়েভের ওই আক্রমণ কৌশল ন্যাটোর সামরিক ডকট্রিন অনুযায়ী ছিল।
কিন্তু বর্তমানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। রাশিয়া ফ্রন্টলাইনে ও তার পেছনে যে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেছে তা হিটলারের থার্ড রাইখ পতনের পর আর কখনো ইউরোপে দেখা যায়নি।
স্পেনের ইউনিভার্সিটি অভ গ্রানাডা'র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হাভিয়ের জর্দান এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিফেন বিডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সিগফ্রিড লাইন ও বর্তমান রুশ প্রতিরক্ষা লাইনের মধ্যে একটি তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। অধ্যাপক জর্দানের মতে, রাশিয়ার এ প্রতিরক্ষা গঠনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের প্রতিরক্ষা লাইনের গুণগত কোনো পার্থক্য নেই।
রাশিয়ান বাহিনী কেবল ফ্রন্টলাইনে প্রতিরক্ষা তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, ফ্রন্টলাইনের পেছনে বিভিন্ন এলাকাতেও শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। তাই ইউক্রেনীয় বাহিনীকে চিরুনি অভিযান চালানোর মতো করে প্রতিটি প্রতিরক্ষা ভেদ করতে হবে যাতে শত্রুসেনারা তাদের পশ্চাৎভাগে অবস্থান করতে না পারে।
আট দশক আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরিতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রাখা হয়েছিল, রাশিয়ান বাহিনীও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। তবে রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে অতিক্রম করা তুলনামূলক সহজ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্রাগন'স টিথ নামক কংক্রিটের ব্লকগুলো মাটিতে পুতে বসানো হতো। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া এগুলোকে কেবল মাটির উপরিভাগেই বসিয়েছে।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা লাইনকে 'সমীহ-উদ্রেককারী' হিসেবে বর্ণনা করেছে যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। জাপোরিজজিয়া ফ্রন্টের মেলিতোপোল ও আজভ সাগর এলাকায় ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ শুরু করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর রাশিয়া এ স্থানেই তিনটি প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করেছে।
১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিনটি সমান্তরাল লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। আর প্রতিটি লাইনেই একই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রেখেছে রাশিয়া — প্রথমে কাঁটাতারের বাধাসমৃদ্ধ পরিখা, এরপর মাইনফিল্ড; তারপরে ড্রাগন'স টিথ, ট্যাংক-বিরোধী গর্ত, এবং পরিশেষে আরও পরিখা।
বিশেষায়িত সাঁজোয়া যানের সরবরাহ বাড়াচ্ছে ন্যাটো
গত ৪ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ান মেজর জেনারেল মিক রায়ান তার এক বিশ্লেষণে লেখেন, ন্যাটো মিত্ররা ইউক্রেনে তাদের অস্ত্র সরবরাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে: যুদ্ধ শুরুর পর এ প্রথমবারের মতো রাশিয়ান প্রতিরক্ষা ভেদ করতে বিশেষভাবে নকশা করা অস্ত্র ও সাঁজোয়া যানের প্রতি অগ্রাধিকার দিচ্ছে ন্যাটো। ওয়াশিংটন কিয়েভকে মাইন-রেসিসট্যান্ট অ্যামবুশ প্রোটেক্টেড (এমআরএপি) সাঁজোয়া যান দিয়েছে যেগুলো মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত এ ধরনের অন্যান্য বিশেষায়িত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে যাত্রাপথে মাইন পরিষ্কার করে এগোতে সক্ষম ট্যাংক, ড্রাগন'স টিথ ও মাইন ধ্বংসে তৈরি এম-৫৮ এক্সপ্লোসিভ চার্জসমৃদ্ধ সাঁজোয়া যান, পরিখা ও ট্যাংক-বিরোধী গর্ত পার হওয়ার জন্য অস্থায়ী ব্রিজ তৈরিতে সক্ষম এম-৬০ সাঁজোয়া যান ইত্যাদি। জার্মানির পক্ষ থেকে ইউক্রেন পেয়েছে অস্থায়ী ব্রিজ নির্মাণে সক্ষম বাইবার সাঁজোয়া যান ও এবং মাইন ধ্বংসের জন্য ভিসেন্ট-১ ভেহিকল। লিথুনিয়া সবরকমের ভূমিতে চলাচলে উপযুক্ত মাইন-প্রতিরোধী সাঁজোয়া যান, ফিনল্যান্ড মাইনফিল্ডের মধ্য দিয়ে চলাচলে সক্ষম লেপার্ড ট্যাংক, নেদারল্যান্ড ব্রেডলি ব্রিজ ও এম-৩ পন্টুন এবং ফ্রান্স জলে-স্থলে সেনা পরিবহনে সক্ষম এএমএক্স-১০পি সাঁজোয়া যান পাঠিয়েছে ইউক্রেনে।
একাধিক পরিখা, মাইনফিল্ড ও মেশিন গানের বাধার বিরুদ্ধে আর্টিলারি সহায়তা ছাড়া কোনো আক্রমণ কার্যকর নয়। এছাড়া রক্ষণভাগে থাকা সেনাদের মনোবলও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। খারকিভের যুদ্ধের সময় রুশ সেনা কমান্ডারদের হত্যা করেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। এর ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যকার চেইন অভ কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। যার দরুন রুশবাহিনীতে তখন বিশৃঙ্খলাও তৈরি হয়েছিল।
তবে ইউক্রেনের আসন্ন আক্রমণের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সব সামরিক ইউনিটের মধ্যকার কার্যকরী সমন্নয়। আর এর জন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব।
বড় ত্যাগ, কম অগ্রগতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেদ করতে ব্লিৎজক্রিগ নামক সামরিক কৌশল অবলম্বন করত। এ পদ্ধতিতে তীব্র গতিতে, প্রচুর শক্তি এ ফায়ারপাওয়ার নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। কিন্তু এত বছরে সামরিক প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে ব্লিৎজক্রিগ কৌশল প্রয়োগ করে এখন আর খুব বেশি সুবিধা করা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বেশি পরিমাণ সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য ও কৌশলী আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে ভূমিতে সাফল্য পাওয়া সম্ভব ইউক্রেনের পক্ষে, তবে তা হবে ধীর ও এর জন্য প্রচুর দাম দিতে হতে পারে ইউক্রেনকে।
উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী কয়েকশ কিলোমিটার দীর্ঘ পরিখা তৈরি করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বিমানবাহিনী কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ইরাকি বাহিনীর এসব প্রতিরক্ষা ধ্বংস করে দেয়। ইউক্রেনের প্রাথমিক সমস্যা হচ্ছে, এটির পক্ষে রাশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থা, আর্টিলারি, ও ট্যাংক ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত বিমানশক্তি নেই। অবশ্য হিমার্সের মতো প্রিসিশন মিসাইল ব্যবস্থা থাকায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে কিয়েভ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দুপক্ষের মধ্যে যে দল নিজেদের বিভিন্ন সামরিক ইউনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয় করতে পারবে, তারাই হবে এ যুদ্ধের বিজয়ীপক্ষ।