ইউক্রেনের আসন্ন বসন্তকালীন আক্রমণ হয়তো দেশটির ও ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে
সংঘাতে নামার আগে প্রস্তুতি নিচ্ছে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা; পরীক্ষা করছে তাদের সাজসরঞ্জাম, প্রিয়জনদের কাছে লিখছে চিঠি, বলা যায় না– এসব তাদের শেষ চিঠিও হতে পারে। আসলে সাধারণ মানুষের জানা নেই – কখন বা কোনদিক থেকে দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত বসন্তকালীন পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শুরু করবে ইউক্রেন। তবে ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ দখলে রাখা আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে অচিরেই এ অভিযান শুরু হবে এমনটাই জানা যাচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
তাই আগামী কয়েক সপ্তাহে যুদ্ধের ময়দানে যা ঘটতে চলেছে, তার ওপর নির্ভর করবে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এবং রাশিয়া-বিরোধী পশ্চিমা জোটের পরিণতি।
বাখমুতে হাজারো সেনা হারিয়েছে রাশিয়া। সেনাভর্তি করতে নতুন আইন পাস করিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; যদিও নতুন সেনাদের যুদ্ধের ময়দানে আনতে মাসখানেক সময় লাগতে পারে।
তাই ইউক্রেন হয়তো এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাবে না।
এদিকে ন্যাটো জোটের থেকে বহুবিধ সমরাস্ত্র: ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, শক্তিশালী কামান ও লাখ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ পেয়েছে ইউক্রেন। পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া থেকে যুদ্ধবিমানও আসছে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো এখনও যুদ্ধবিমান দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়, যেমন দীর্ঘসুত্রিতা তারা এর আগে ট্যাংক সরবরাহের ক্ষেত্রেও করেছে।
তাই প্রশ্ন হলো; বর্তমান সুবিধাকে ইউক্রেন কীভাবে কাজে লাগাবে? এই শক্তি দিয়ে তারা ক্রিমিয়ার সাথে রাশিয়ার স্থলসংযোগকে বিচ্ছিন্ন করা বা অন্ততপক্ষে ব্যাহত করার চেষ্টা করতে পারে। ডনবাস অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এই সংযোগ ব্যাহত হলে ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়া ঝুঁকির মুখে পড়বে। তখন নৌপথে এবং কের্চ সড়ক-রেলসেতুই হবে অবশিষ্ট যোগাযোগের মাধ্যম। উল্লেখ্য, অক্টোবরে এক হামলায় কের্চ সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত নভেম্বরে দক্ষিণের খেরসন প্রদেশের নিপার নদীর ওপর পাড়ে রুশ বাহিনীকে সরে যেতে বাধ্য করে ইউক্রেন। তারপর এই যুদ্ধাঞ্চলে কোনো পক্ষই অগ্রসর হতে পারেনি পাঁচ মাস ধরে। বিরাজমান রয়েছে এক ধরনের স্থিতবস্থা। ইউক্রেনের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ বিপজ্জনক, কারণ এতে যে নতুন সংঘাত রেখা তৈরি হয়েছে, তার ব্যাপ্তিজুড়ে স্থবির হয়ে পড়তে পারে লড়াই। উত্তর ও পূর্ব রণাঙ্গনের স্থবির অবস্থার কারণেই ইউক্রেন তার সমুদ্রসীমানার বড় অংশ আর ব্যবহার করতে পারছে না। এতে দেশটির পণ্যদ্রব্য রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে।
তাই যেকোনো শান্তি আলোচনায় বসার আগে ইউক্রেনকে উত্তর ও দক্ষিণের আরো বেশি ভূখণ্ডকে দখলমুক্ত করতে হবে। কেবল তাহলেই আলোচনায় দর কষাকষির সুবিধে করতে পারবে। এতে করে, যেটুকু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ তখনো রাশিয়ার কাছে থাকবে, পুতিন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হবেন।
কিন্তু, এই আক্রমণ পরিকল্পনার ঝুঁকিও প্রচণ্ড। ইউক্রেনের সরবরাহ লাইন বেশ সীমিত, রাশিয়ার বোমারু বিমান ঠেকানোর মতো যথেষ্ট বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও নেই। অন্যদিকে, রণাঙ্গনের সম্মুখসারিতে পরিখা ও অন্যান্য প্রতিরোধ কাঠামো গড়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে রুশ সেনারা। আক্রমণের ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের শত্রুর চেয়ে বেশি সেনারও দরকার হবে। রণাঙ্গনের মুষ্টিমেয় কিছু জায়গাতেই এই সংখ্যাধিক সেনা সমবেত করতে পারবে কিয়েভ। আর তা দিয়ে যদি কিছু জায়গায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে সামনে এগোতেও পারে, তারপরেও থাকে শত্রু দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ার ঝুঁকি।
একইসঙ্গে, ইউক্রেনের সমর্থকদের এটাও স্মরণে রাখতে হবে যে আসন্ন অভিযানই শেষ লড়াই নয়। অবশ্যই এরপরেও অনেক খণ্ডযুদ্ধ হবে। তাই এ অভিযান সমাপ্ত হওয়ার পর যেটুকু ভূখণ্ড দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে – তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত ইউক্রেনের। এরপর রাশিয়া হয়তো পাল্টা হৃত ভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করবে, সেজন্য ইউক্রেনীয়দের শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়তে হবে। বাখমুতের আশেপাশে রাশিয়ার আক্রমণ সম্প্রতি থমকে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, সবক্ষেত্রেই এমনটা হবে। তাই আমেরিকা ও ইউরোপকেও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে, যে তারা ইউক্রেনের আরো ভূখণ্ড দখলের বিরোধিতা করবে।
তাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, পুতিনকে ঠেকাতে প্রয়োজন হলে সামনের আরো অনেক বছর তারা ইউক্রেনকে সাহায্য করবে। পশ্চিমারা যত দ্রুত কিয়েভের প্রতি তাদের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতিগুলো ব্যক্ত করবে, ততোই মঙ্গল। অবশ্য ১৯৯৪ সালেও রাশিয়া, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য – ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল। সেই অঙ্গীকার রক্ষা হয়নি বলেই পুতিন আগ্রাসন চালাতে পেরেছেন। তাই এবারে পশ্চিমাদের প্রতিশ্রুতি যেন, নিখাঁদ হয় – সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।