তীব্র তাপদাহে হুমকিতে ভারতের ১০০ কোটি মানুষ: গবেষণা
গতবছর ভারতে স্বাভাবিকের তুলনায় গড়ে ১৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট অতিরিক্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। শুধু গত বছরই নয় বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতেও ভারতে অহরহ তীব্র তাপদাহের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে উঠে এসেছে নতুন এক গবেষণায়। খবর ওয়্যার্ডের।
গত ১৯ এপ্রিল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাপদাহ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। এতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মুখে থাকা সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বর্তমানে ভারতে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের বসবাস। গত বছর তীব্র তাপদাহে দেশটির প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছিল। তখন হিটস্ট্রোক, খাবার সংকট ও মৃত্যুর খবরও অহরহ পাওয়া যায়। গবেষণা মতে, তীব্র তাপদাহের কারণে দেশটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এ অবস্থায় দেশটিতে বিদ্যুতের চাহিদাও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে থাকে। তবুও বিদ্যুতের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
এমনকি গত বছর তীব্র তাপদাহে ভারত জুড়ে ৩০০ এরও বেশি দাবানলের খবর পাওয়া যায়।
গবেষণায় বলা হয়, "একের পর এক তীব্র তাপদাহ জনস্বাস্থ্য, কৃষি, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। দেশ হিসেবে ভারত জলবায়ুগত একাধিক বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে।"
তবে ভারত সরকার অবশ্য তীব্র তাপদাহ নিয়ে অতটা বিচলিত নয়। দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডিজাইনকৃত মডেলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। ঐ পর্যালোচনা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের খুবই কম এলাকাই বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
তবে ক্যামব্রিজের গবেষণামতে, জলবায়ু নিয়ে ভারতের এমন ভুল পর্যালোচনা ক্ষুধা, দারিদ্রতা ও লিঙ্গসমতার মতো এসডিজির গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এমনকি গবেষণাটি পিএলওএস ক্লাইমেট জার্নালে প্রকাশের একদিন আগেও ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ মহারাষ্ট্রে ১৩ জন মানুষ হিটস্ট্রোকে মারা গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বহু মানুষ।
গত সপ্তাহে ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এতে করে ঐসব অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার।
গত ২০ বছরে ভারতে তীব্র তাপদাহে অন্তত ২৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই সময়টাতে ভারত ও পাকিস্তান মিলিয়ে প্রায় ১০০ বারের মতো তীব্র তাপদাহের অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
এ অবস্থায় গড়ে প্রতি তিন বছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় রেকর্ড তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন না হলে গড়ে ৩১২ বছরে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড তৈরির কথা ছিল।
গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদী পর্যালোচনায় বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের তীব্র তাপদাহের মাত্রা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সহনশীল তাপমাত্রার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে চলতি বছরের মধ্যেই ভারত জনসংখ্যার দিক বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে তীব্র তাপদাহ বিশাল জনসংখ্যার এ দেশটির অর্থনীতির গতিকে মন্থর করে দিতে পারে।
গবেষণামতে, ভারতের শ্রমশক্তির শতকরা ৭৫ ভাগই উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করে থাকে। এতে করে তীব্র তাপদাহের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাইরে কাজ করার সক্ষমতা প্রায় ১৫ ভাগ কমে যাবে। এর ফলে চলতি শতাব্দীর শেষদিকে দেশটির জিডিপি হার শতকরা ৮.৩৭ ভাগ কমে যেতে পারে।
ক্যামব্রিজের গবেষকদের মতে, ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের শহর দিল্লি তীব্র তাপদাহের কারণে মারাত্মক সংকটের মুখে রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকারের পর্যালোচনা মতে, শহরটির ১১টি জেলার মধ্যে মাত্র দুইটি জেলা জলবায়ুগত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ এবং বিদ্যুৎ, পানি, পয়নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনার ফলে দিল্লির বাসিন্দারা তাপদাহের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বিশেষ করে তাপদাহে স্বল্প আয়ের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কমাতে এখনই কাঠামোগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে গুজরাটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিরেক্টর দিলিপ মাভালঙ্কার বলেন, "তীব্র তাপদাহের ফলে সৃষ্ট সংকট কতটা মরণঘাতী হতে পারে সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি সরকার।"