দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে রাশিয়া, পাচ্ছে সাফল্যও
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মির বেলচা ব্যবহারের দক্ষতায় থ বনে গিয়েছিল জার্মান সেনারা।
স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধে সোভিয়েতরা পরিখাখনন ও ক্যামোফ্লেজে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল। জার্মান কমান্ডারেরা বলতেন, রেড আর্মির ব্রিজহেডকে দ্রত আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলতে হতো, কারণ একবার সোভিয়েতরা পরিখার ভেতরে আশ্রয় নিলে তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো।
ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাদের দুর্বলতা ভ্লাদিমির পুতিনের সোভিয়েত যুগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। তবে রাশিয়ান সামরিক প্রকৌশলীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী দক্ষতা ভুলে যাননি এখনো। ফ্রন্টলাইনে তাদের তৈরি করা দুর্গ ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার মানে এমন নয় যে রাশিয়ানরা তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি)-এর এক প্রতিবেদনে বরং বলা হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরিতে 'স্বল্প পদ্ধতিগত পরিবর্তন' এসেছে।
'রাশিয়ানরা পরিখা নির্মাণে গতানুগতিক সামরিক পরিকল্পনা অনুসরণ করে। তাদের এ পদ্ধতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে,' গত ডিসেম্বরে লুহানস্কে রুশ সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা।
ইউক্রেনের জন্য এখন বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা। গত বছরের শেষ দিক থেকে ফ্রন্টলাইনে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরি করেছে রাশিয়া।
তাদের এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে কংক্রিটের লাইন বসানো পরিখা, কাঁটাতার, ড্রাগন'স টিথ (পিরামিড আকৃতির কংক্রিটের বাধা), ট্যাংকবিরোধী গর্ত, এবং অসংখ্য ট্যাংকবিধ্বংসী ও অ্যান্টি-পারসোনেল মাইন।
প্রতিটি রাশিয়ান ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত দুটি ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি। এর একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো স্থাপন করে, অন্যটি মাইন পরিষ্কার ও বসানোর কাজ করে।
রাশিয়ান প্রতিরক্ষা লাইনের প্রথমে রয়েছে পদাতিক সেনাদের জন্য ফক্সহোল তথা ছোট ছোট গর্ত। এর পেছনে দ্বিতীয় সারির পরিখা ও সঙ্গে কংক্রিটের তৈরি গুলিবর্ষণের পোস্ট। সেগুলোকে প্রতিরক্ষা দিচ্ছে আরও একাধিক বাধা।
এসব বাধার প্রতিটি আধা মাইলের চেয়ে প্রশস্ত — এগুলো গড়ে তোলা হয়েছে কাঁটাতার ও ড্রাগন'স টিথ দিয়ে। আর ট্যাংকবিধ্বংসী গর্তগুলো প্রতিটি ২০ ফুট চওড়া ও ১৩ ফুট গভীর।
প্রতিরক্ষাব্যুহের দ্বিতীয় সারি গড়ে উঠেছে জঙ্গুলে ও পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন কোম্পানি অবস্থান নেওয়ার জন্য তৈরি স্থাপনার মাধ্যমে। এখানে অবস্থিত সেনারা প্রথম সারির প্রতিরক্ষাকে যুদ্ধের সময় কাভার দিতে সক্ষম।
প্রথম স্থাপনা থেকে মাইল তিনেক দূরে অবস্থিত তৃতীয় সারির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এখানে সেনাদের প্রয়োজনে পিছু হটে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এসব দুর্গসম অবস্থানে একাধিক রাশিয়ান ইউনিট থাকার সম্ভবনাও রয়েছে।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে রুসি জানিয়েছে, কোনও কোনও এলাকায় রাশিয়ার এ প্রতিরক্ষা লাইন ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
যদি কখনো ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি না পাওয়া যায়, তখন রাশিয়ান সেনা সদস্যরা নিজেরাই পরিখা খনন শুরু করেন।
রাশিয়ার এ প্রতিরক্ষার সবচেয়ে অভেদ্য অংশ সম্ভবত এর মাইনগুলো। আর রাশিয়ার কাছে 'মাইনের কোনও অভাব নেই' বলে দাবি করা হয়েছে রুসি'র প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি রাশিয়ার মাইনফিল্ডের মুখে পড়ে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা কয়েকটি লেপার্ড ২ ট্যাংক ও ব্র্যাডলি ইনফ্যান্ট্রি ভেহিকল হারিয়েছে ইউক্রেন। ওই আক্রমণে সুবিধা করতে পারেনি ইউক্রেন।
রাশিয়ার মাইনের একাধিক ট্রিগার এ অ্যান্টি-টেম্পারিং ডিভাইস থাকার কারণে এগুলো অকেজো করা কঠিন। এছাড়া রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে চুম্বকীয়ভাবে সক্রিয় করা যায় এমন ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন স্থাপন করার প্রযুক্তিও রয়েছে রাশিয়ার কাছে।
তবে রুশ মাইনের বিরুদ্ধে পুরোপুরি অসহায় নয় ইউক্রেনও। ফিনল্যান্ড কিয়েভকে আধা ডজন মাইন পরিষ্কারক লেপার্ড ২ ট্যাংক দিয়েছে। যদিও এগুলোর কয়েকটি ইতোমধ্যে ধ্বংস করেছে রাশিয়ানরা। যুক্তরাষ্ট্রও মাইনবিরোধী সাঁজোয়া যান দিয়েছে ইউক্রেনকে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো অল্পসংখ্যক বিশেষায়িত যান ব্যবহার করে ইউক্রেন রাশিয়ার গভীর এ দুর্গ জয় করতে পারবে কি না। এছাড়া রুশ মাইনগুলো কোনো প্যাটার্ন অনুসরণ করে বসানো হয়, ফলে এগুলোকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য।
পাশাপাশি রাশিয়া ১৯৯৭ সালে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন নিষিদ্ধ করা অটোয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। ফলে এটি নিজের ইচ্ছামতো এ ধরনের মাইন ব্যবহার করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে বর্তমানে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন মানুষ কর্তৃক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অথবা এ মাইনগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পরে নিজে থেকেই বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু রাশিয়ার মাইনগুলো ভুক্তভোগী দ্বারা বিস্ফোরিত হয়।
অর্থাৎ কেউ এ মাইনগুলোর ওপর পা রাখলেই সেগুলো বিস্ফোরিত হবে। ফলে ভবিষ্যতে রাশিয়ানেরা চলে গেলেও ইউক্রেনের সাধারণ মানুষেরা এসব মাইনের কবলে পড়ে হতাহত হবেন।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অটোয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোকে তাদের মজুত থাকা অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন ধ্বংস করার কথা। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবর্তী ডিমিলাটারাইজড এলাকায় থাকা বড় মাইনফিল্ড ধ্বংস করতে অনিচ্ছুক পেন্টাগন।