দক্ষিণ কোরিয়ার শিশু চিকিৎসকরা কম জন্মহারের কারণে পেশা ছাড়ছেন!
দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। দেশটিতে বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহার এবং এর পেছনে একটি ফ্যাক্টর কাজ করাকে এই সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শিশু চিকিৎসকের অভাবে হাসপাতালগুলো এই পদে নিয়োগের কোটা পূরণ করতে পারছে না, ফলে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থিংক ট্যাংক সিউল ইনস্টিটিউট এর তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীতে পেডিয়াট্রিক ক্লিনিক এবং হাসপাতালের সংখ্যা ১২.৫ শতাংশ কমে মাত্র ৪৫৬টিতে নেমে এসেছে। একই সময়ের মধ্যে সাইকিয়াট্রি ক্লিনিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৬.৮ শতাংশ এবং অ্যানেস্থেসিওলজি সেন্টারের সংখ্যা বেড়েছে ৪১.২ শতাংশ।
সাতজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ রয়টার্সকে বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি দেখা যাওয়ার সমস্যার মূলে রয়েছে দেশটিতে জন্মহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া। ২০২২ সালে দেশটিতে শিশু জন্মহার ছিল ০.৭৮ শতাংশ। মাথাপিছু নারীদের সন্তান জন্মদানের গড় হার ধরা হয়েছিল এটিকে- কিন্তু সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বীমা ব্যবস্থার ব্যর্থতা; ফলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা পর্যাপ্ত সম্পদ-সংস্থানের অভাবে ভোগেন এবং চিকিৎসকরা মনে করেন এই খাতের কোনো ভবিষ্যত নেই।
দেশটির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই সিস্টেমের 'সীমাবদ্ধতা' স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেটা অনুযায়ী, হাসপাতালগুলো এবছরের প্রথমার্ধের মধ্যে মাত্র ১৬.৩ শতাংশ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সেবাদান নিশ্চিত করতে পেরেছে; অথচ ২০১৩ সালে তা ছিল ৯৭.৪ শতাংশ।
আর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের এই ঘাটতির ফলে মা-বাবাদের সন্তানের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়।
এক সকালে সিউলের উপকণ্ঠে একটি হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখা যায় সেখানে ডজন ডজন শিশু, অনেকের আবার শিরার মধ্য দিয়ে তরল প্রবেশ করানো হচ্ছে।
হেলদি চিলড্রেনস হসপিটালে ৩৫ বছর বয়সী এক মা লি বো-মি তার তিন বছর বয়সী অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, "আমাদেরকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে!"
কোরিয়া ইউনিভার্সিটি গুরো হসপিটাল-এর ডা. সং দাই-জিন জানান, তিনি এই ভেবে ভয় পাচ্ছেন যে খুব শীঘ্রই কর্মী সংকটের কারণে হয়তো তার টিম জরুরি সেবা দিতে পারবে না।
"এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা এই বছর পর্যন্তও টিকে থাকতে পারব না। ছোটখাট অসুখ যদি দুয়েকদিন পরে ডাক্তার দেখানো হয় সেটা কোনো বড় সমস্যা না, কিন্তু গুরুতর অসুখে যদি ডাক্তার দেখানো না যায় কিংবা ইমার্জেন্সি রোগীদের যদি সময়মতো ডাক্তার দেখানো না যায়, তাহলে পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ", বলেন সং।
গত মাসেই দক্ষিণ কোরিয়ায় রেসপাইরেটরি ইনফেকশনে আক্রান্ত পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু হাসপাতালে বেড না পেয়ে এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ ঘটনা দেশজুড়ে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
"রোগীরা একটার পর একটা ইমার্জেন্সি রুমের আশেপাশে চক্কর দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত মারা যাচ্ছে, কখনো কখনো গুরুতর রোগ না থাকা সত্ত্বেও মারা যাচ্ছে...এটা তো খুবই অযৌক্তিক", বলেন কোরিয়া চিলড্রেন'স হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. চোই ইয়ং-জাই।
'আমি চিন্তিত'
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের জন্য কম ফি এর বিষয়টাও একটা সমস্যা, কারণ বীমার সিস্টেমে অল্পসংখ্যক শিশু রোগীদের জন্য সেভাবে তৈরি করা হয়নি। দেশে অনেক শিশু বেড়ে উঠতে থাকলে তখন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা 'লো প্রাইস, হাই ভলিউম' মডেল অনুসরণ করতে পারতো, কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না।
"বাইরের দেশগুলোতে সরকার হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যথেষ্ট টাকা দেয়, এমনকি একদিনে ২০টা রোগী দেখলেও। কিন্তু কোরিয়ায় প্রতি ট্রিটমেন্টে নেওয়া হয় ১০ ডলার, তাই একজন ক্লিনিকগুলোকে একদিনে প্রায় ৮০ জন রোগী দেখতে হয়", বলেন কোরিয়ান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন এর ডা. লিম হিউন-তায়েক।
তুলনামূলকভাবে, একজন অস্ট্রেলিয়ান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের কনসাল্টেশনের জন্যই দিতে হয় প্রায় ৩৩৫ ডলার। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনওয়াইড চিলড্রেন'স হসপিটাল-এ অবজারভেশনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় খরচ করতে হয় ২০৮ ডলার।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চিকিৎসা খাতে সীমাবদ্ধতা দূর করার উদ্দেশ্যে এবছর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের ফি এবং বীমা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে নতুন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারা সরকারি সহায়তাপুষ্ট চিকিৎসা সেন্টার তৈরি এবং প্রধান হাসপাতালগুলোতে 'ইমার্জেন্সি পেডিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট' বা জরুরি শিশু সেবা ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলে, "আমরা বুঝতে পারছি যে চিকিৎসকরা মনে করেন- এই খাতের সমস্যা ও জটিলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। কিন্তু ঘোষিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের ও সেই লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।"
হেলথ ইনস্যুরেন্স রিভিউ এবং অ্যাসেসমেন্ট সার্ভিস-এর ডেটা থেকে জানা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা দেশটির সবচেয়ে পারিশ্রমিক পাওয়া চিকিৎসক। গড়পরতা চিকিৎসকদের বেতনের চেয়ে তাদের আয় ৫৭ শতাংশ কম।
হাসপাতালগুলো এ সমস্যাটি প্রবলভাবে অনুভব করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে পুরনো শিশু হাসপাতাল সোওহা হসপিটাল বিগত ৭৭ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম কর্মীর অভাবে চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। গত শনিবার বিকালে এবং রবিবারের তাদের চিকিৎসা সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।
আবার কোনো কোনো হাসপাতাল রাতেরবেলা চিকিৎসা সেবা দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে এবং শিশুদের ইমার্জেন্সি রুম বন্ধ করে দিয়েছে।
পরিস্থিতি এতটাই আশঙ্কাজনক যে কোনো কোনো জুটি বলেছেন, দেশে জন্মহার বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রচেষ্টা এবং চাইল্ডকেয়ারে ভর্তুকি হিসেবে বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে চাওয়া সত্ত্বেও চিকিতসাব্যবস্থার এই অবস্থা দেখে তাদের মধ্যে সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে আরও সংশয় কাজ করছে।
৩৪ বছর বয়সী কিম ইউন-জি এক বছর বয়সী এক ছেলের মা। দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমি চিন্তিত। যদি দেশে শিশু হাসপাতালের সংখ্যা এভাবে কমতে থাকে এবং ডাক্তারের সংখ্যা কমতে থাকে, তাহলে বাচ্চাদের চিকিৎসা করানোই মুশকিল হয়ে যাবে।"
'খুবই ঝুঁকিপূর্ণ'
ন্যামসিউল ইউনিভার্সিটির হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর অধ্যাপক লি জু-ইয়ুল বলেন, পেডিয়াট্রিক কেয়ারের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দে ব্যর্থ হওয়ায় সেটা জন্মহার বৃদ্ধির জন্য মোটা অংকের টাকা খরচ করাকে অবমূল্যায়িত করেছে।
"আমাদের অবশ্যই কিছুটা বাজেট রাখতে হবে যাতে বাবা-মায়েরা নিশ্চিত হতে পারেন যে এই দেশে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হবে না", বলেন লি।
কোরিয়ান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি শত শত সদস্যের জন্য একটি সেমিনার আয়োজন করেছে, যেসব সদস্য কিনা শিশু সেবা খাত ছেড়ে অন্য খাতে যেতে আগ্রহী- বিশেষ করে সৌন্দর্য্য খাতে।
এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লিম বলেন, "আয়ের সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে এই সময়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে কাজ করা একটা জুয়াখেলার মতো। কিছু চিকিৎসক শিশুদের চিকিৎসা করতে ভালোবাসেন ঠিকই... কিন্তু এখন সেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"