ভারতে টমেটোর দাম বেড়েছে ৪০০ শতাংশ! খাবারের পদ থেকে টমেটো বাদ
বাটার চিকেন থেকে শুরু করে পনির মাখনি, টমেটোর সর্বময় ব্যবহার ছাড়া ভারতীয় রন্ধনপ্রণালীর কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু আকাশছোঁয়া দামের কারণে এই সবজি এখন নিজেদের রান্নাঘর ও রেস্টুরেন্টের খাবারের মেন্যু থেকে বাদ দিতে চাইছেন ভারতীয়রা। কৃষক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ এবং ভারী বৃষ্টিপাতের পর পর্যাপ্ত টমেটো উৎপাদন না হওয়ায় বাজারে এটির দাম বৃদ্ধির হার ৪০০ শতাংশেরও বেশি।
চলতি সপ্তাহে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর বাজারগুলোতে এক কেজি টমেটো বিক্রি হয়েছে ১৩৮ রূপি করে। কিন্তু ভারতের ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংস্থার ডেটা অনুযায়ী, এবছরের জানুয়ারিতেই টমেটোর দাম ছিল প্রতি কেজি মাত্র ২৭ রূপি।
রাজধানীতে বসবাসরত, আশা নামের একজন গৃহিণী সিএনএনকে জানান, টমেটোর এমন আকাশছোঁয়া দাম তার সাত সদস্যের পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কারণ তিনি যেসব খাবার রান্না করেন, প্রায় সবগুলোতেই টমেটো ব্যবহার করেন।
"টমেটোর উচ্চমূল্য আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। এরকম দাম অবিশ্বাস্য! আমরা যেসব শাকসবজি খাই তার মধ্যে টমেটো অন্যতম... কিন্তু গত কিছুদিন যাবত আমাকে রান্নার সময় খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে কারণ এখন এই সবজিটির দাম অনেক বেশি", বলেন আশা।
শুধু যে আশার পরিবারই সমস্যায় পড়েছে তা নয়; ভারতজুড়ে ম্যাকডোনাল্ড'স এর কিছু রেস্টুরেন্টকেও সাময়িকভাবে তাদের বার্গারে টমেটো দেওয়া বন্ধ রাখতে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা সরবরাহে ঘাটতি এবং গুণগত মান বিষয়ক সমস্যার কথা জানিয়েছে ক্রেতাদের।
কোনাট প্লাজা রেস্টুরেন্টস ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ম্যাকডোনাল্ড'স এর ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দেখাশোনা করে। তারা ওই সকল রেস্টুরেন্টের বাইরে নোটিশ বোর্ডে লিখেছে, 'আমাদের বিশ্বমানের গুণগত মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এমন টমেটো পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না।'
এই নোটিশ বোর্ডের ছবি ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, এমনকি আম আদমি পার্টির নেতা রাঘব চাড্ডাও শেয়ার করেছেন এর ছবি।
রাঘব চাড্ডা টুইটারে লিখেছেন, "এমনকি ম্যাকডোনাল্ড'সও এখন টমেটো কিনতে পারছে না। আমাদের ঘর হোক বা রেস্টুরেন্ট, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার আমাদের হ্যাপি মিলকে 'স্যাড মিল'-এ বদলে দিয়েছে।"
বর্তমানে ভারতে টমেটোর ঘাটতির পেছনে অন্যতম কারণ হলো চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বলেন টাটা কর্নেল ইনস্টিটিউট ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন-এর পোস্ট ডক্টোরাল অ্যাসোসিয়েট জোসেলিন বোইতাউ।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য অংশে তীব্র তাপমাত্রা বিরাজ করছে। দুটি ক্লাইমেট ট্র্যাকিং এজেন্সি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
জলবায়ু-সংক্রান্ত কারণসমূহ
গ্রীষ্মকালে মে ও জুন মাসে ভারতে প্রায়ই তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপপ্রবাহের সময় এগিয়ে এসেছে এবং দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
গত এপ্রিলে ভারতে একটি তাপপ্রবাহের ফলে টানা সাতদিন নয়াদিল্লির তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। কিছু কিছু রাজ্যে তাপপ্রবাহের ফলে স্কুলও বন্ধ রাখতে হয়েছে। এছাড়াও, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণ জনগণকে ঘরের ভেতরে থাকার এবং বেশি বেশি পানি পান করার নির্দেশ দেওয়ায় শক্তি সরবরাহের ওপর চাপ তৈরি হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল-এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, জলবায়ু সংকটের ফলে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে ভারত একটি এবং তা দেশটির ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রভাবগুলো হবে ভয়াবহ।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গত এপ্রিলে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতে তাপপ্রবাহ দেশটির কৃষি, অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর 'নজিরবিহীন চাপ' তৈরি করছে এবং দেশটির উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা ব্যহত করছে।
বোইতাউর মতে, শুধুমাত্র ভারতের দক্ষিণের কয়েকটি অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে টমেটো উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। তাই এসব অঞ্চলে জলবায়ু-সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা তাজা টমেটো সরবরাহের ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে এবছর গ্রীষ্মকালে নজিরবিহীন বৃষ্টিপাত এবং প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে ভারত। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি জলবায়ু সংকটের প্রভাবে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ভারতের ভেজিটেবল গ্রোয়ারস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি শ্রীরাম গারভে বলেন, এবছর গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত একের পর এক তাপপ্রবাহের ফলে ওই সময়ে টমেটো গাছগুলোতে ফুল ধরেনি যা টমেটোর ফলনকে প্রভাবিত করেছে।
এরপরেও যেসব টমেটো উৎপাদন হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশ টমেটো বীজ থেকে জন্মানো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান গারভে। ফলে টমেটো সরবরাহে ঘাটতি আরও প্রকট হয়েছে।
ভারতের একজন কৃষি নীতি বিশেষজ্ঞ, দেবিন্দর শর্মা সিএনএনকে বলেন, বর্তমানে টমেটোর ঘাটতির পেছনে আরও একটি কারণ হলো- কেউ টমেটো কিনতে চায় না দেখে কৃষকেরা তাদের টমেটো ফেলে দেন। প্রতিবছরই এরকম কিছু ঘটনা ঘটে, তবে এবছর তা অধিক মাত্রায় ছিল।
গারভে জানান, টমেটোর দাম খুব শীঘ্রই স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা যাচ্ছে; কারণ ফসল তোলার সময় হয়ে এসেছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন টমেটো বিক্রির জন্য বাজারে ওঠার কথা।