ভাগাড়ে থাকা পুরোনো কোল্ড ওয়ার যুগের ট্যাংক কেন সচল করছে রাশিয়া?
সামরিক পরিকল্পনায় যথেষ্ট ঘাটতি, অদূরদর্শীতা এবং গোয়েন্দা তথ্যের অভাবে – যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ইউক্রেনে বড় সংখ্যক ট্যাংক হারায় রাশিয়া। এপর্যন্ত ১,৮০০'র বেশি রুশ ট্যাংক ধবংসের প্রমাণ মিলেছে। এরমধ্যে রাশিয়ার ট্যাংক বহরের মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত, টি-৭২ ট্যাংক বহরের অর্ধেকের বেশি ধবংস হয়েছে। ইউক্রেনের সাঁজোয়া বহরের ক্ষতিও বিশাল। কিন্তু, পশ্চিমা মিত্রদের থেকে আরো ট্যাংক চাইবার সুযোগ রয়েছে কিয়েভের। আর সেটাই করছে জেলেনস্কি প্রশাসন। অন্যদিকে, সংরক্ষণাগারে রাখা পুরোনো ট্যাংক সংস্কার করে সাঁজোয়া বহর আবারো গড়ে তুলতে পারবে রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় থেকেই বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ট্যাংক বোনইয়ার্ড বা ভাগাড়ে ফেলে রাখা হয় হাজার হাজার ট্যাংক। রুশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুদাম বা সংরক্ষণাগারেও রয়েছে একই রকম মজুত। এসব ট্যাংক সংস্কার করে রাশিয়া যুদ্ধে জিততে পারবে কিনা – সে প্রশ্নই এখন দেখা দিয়েছে।
পুতিনের প্রিয় কারখানা ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না
রাশিয়ার একটি মাত্র নতুন ট্যাংক উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এর নাম উরালভাগনজাভড (ইউভিজেড) বা উরাল ফ্রেইট কার কারখানা। রাজধানী মস্কো থেকে এক হাজার মাইল পূর্বে নিঝনি তাগিলে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই স্থাপনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এই প্ল্যান্টের নাম ছিল স্টালিন উরাল ট্যাংক ফ্যাক্টরি নং - ১৮৩। নজিরবিহীন উৎপাদনের মাধ্যমে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় অসামান্য অবদান রাখায়, স্থাপনাটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'অর্ডার অব লেনিন' দেয়া হয়। যুদ্ধকালে প্রায় ২৫ হাজার টি-৩৪ ট্যাংক উৎপাদন করে ইউভিজেড, যা ছিল মোট উৎপাদনের অর্ধেক।
পুতিনের প্রিয় সমরাস্ত্র কারখানা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে উরালভাগনজাভড- এর। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে কারখানার আধুনিকায়ন থমকে যায়। এক সময়ের গর্বিত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার হয় অবনতি। এমনকী ২০১৬ সালের দিকে কারখানাটি দেউলিয়াত্তের কিনারে এসে দাঁড়ায়। বর্তমানে তারা রেলওয়ের রেফ্রিজেরেটেড ফ্রেইট কার বা বগিসহ বেসামরিক যন্ত্রপাতিও উৎপাদন করে। তবে তাদের প্রধান আয়ের উৎসই হলো সমরাস্ত্র উৎপাদন।
এই কারখানা তৈরি করেছে বিশ্বের সর্বাধুনিক টি-১৪ আরমাটা ট্যাংক। তবে উদ্ভাবনের আট বছর পরেও ডিজাইনের বিভিন্ন ত্রুটি ও কারিগরি সমস্যার সমাধান না হওয়ায়– এর ব্যাপক উৎপাদন শুরু করা যায়নি। রাশিয়ার অপর অত্যাধুনিক ট্যাংক, টি-৯০ উৎপাদন করে এই প্ল্যান্ট। মাসে এ ধরনের ২০টি ট্যাংক উৎপাদনের কথা থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে তা আরো কম হচ্ছে।
ব্রিটিশ সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক সদস্য সার্জিও মিলার বর্তমানে একজন স্বাধীন বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত। তিনি পপুলার মেকানিক্সকে জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না ইউভিজেড।
"যুদ্ধের শুরুতে দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে কারখানার সকল কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষের কাছে আকস্মিক দুর্যোগ ছিল এই ঘটনা।"
রুশ সামরিক বাহিনীর বিষয়ে উন্মুক্ত উৎসে থাকা তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন মিলার, তার ওপর ভিত্তি করে তিনি জানান, গত এক বছরে মাত্র চার ব্যাচ টি-৯০এম ট্যাংকের ডেলিভারি দিয়েছে উরালভাগনজাভড। 'প্রতিটি ব্যাচে কোম্পানিটি ১০টি ট্যাংক সরবরাহ করেছে বলেই মনে করা হয়'। অর্থাৎ, এসময়ে মোট ৪০টি এই ট্যাংক উৎপাদন করা হয়েছে।
তবে নতুন ট্যাংক উৎপাদনের এই অবস্থা হলেও, বিকল্প উপায়ে ট্যাংক সংগ্রহের সুযোগ আছে রাশিয়ার।
যেমন রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ডিপোগুলোয় অন্তত ১০ হাজারের বেশি পুরোনো ট্যাংক রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, ১৯৯০ দশকের প্রথম সংস্করণের টি-৯০ থেকে শুরু করে ১৯৪০-৫০ এর দশকের প্রাচীন টি-৫৪ শ্রেণির যুদ্ধযান। তবে এরমধ্যে মাত্র ১০ শতাংশই কার্যকর অবস্থায় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মূলত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও আবহাওয়া এজন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো ট্যাংক সংরক্ষণ করে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মরুভূমিতে, যেখানে আবহাওয়া বেশ শুস্ক। অন্যদিকে, খোলা আকাশের নিচে রুশ ট্যাংকগুলোকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির মধ্যে কাটাতে হয়েছে যুগের পর যুগ। অনেক দামি সরঞ্জাম, ধাতু, ইলেকট্রনিক ও ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ চুরিও হয়েছে।
কিন্তু, অচল পুরোনো ট্যাংককে এখনও মেরামত করে সচল করতে পারবে রাশিয়ার ব্রোন ট্যাংকোভি রেমোন্তনি জাভোদস ( বা সাঁজোয়া যান মেরামত কারখানাসমূহ), যাদের সংক্ষেপে বিটিআরজেড বলা হয়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও উপদেষ্টা নিকোলাস ড্রুমন্ড বলেন, "যদি ধরে নেই পুরোনো মডেলের ট্যাংকগুলো জং ধরে একেবারে ধবংসপ্রাপ্ত হয়নি, তাহলে সহজেই সেগুলোর সংস্কার করে সার্ভিসে যুক্ত করা সম্ভব।"
রিঅ্যাক্টিভ আর্মার, আধুনিক অপটিক্স এবং সিফোরআই (কম্যান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন্স ও ইন্টেলিজেন্স) সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়তো দুষ্কর হবে না, কিন্তু এগুলোর যথেষ্ট সরবরাহ পাওয়াই মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
বর্তমানে ট্যাংক সংস্কারের জন্য রাশিয়ার তিনটি কারখানা রয়েছে: ওমস্কট্রান্সম্যাশ বা ওমস্ক ট্রান্সপোর্ট মেশিন ফ্যাক্টরি, সেইন্ট পিটাসবার্গের ৬১তম বিটিআরজেড এবং সাইবেরিয়ার ১০৩তম বিটিআরজেড। এর আগে ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও ভিয়েতনামে রপ্তানির জন্য ট্যাংক সংস্কার ও উন্নতকরণের কাজ করেছে কারখানাগুলো। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ান সাঁজোয়া বহরের ক্ষয়ক্ষতি পূরণে দিনরাত্রি কাজ চলছে সেখানে।
গতবছর মস্কো প্রশাসনিক অঞ্চলে ৭২তম এবং রোস্তভে ৭১তম বিটিআরজেড স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। খুব শিগগিরই নতুন এ দুটি কারখানা চালু হবে - যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁজোয়া যান মেরামত ও পুরোনো ট্যাংক সংস্কারের জন্য।
ট্যাংক সংস্কারের কাজ যেভাবে করা হয়
বেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই পুরোনো ট্যাংককে নতুন রূপদান করা হয়। কারখানায় কোনো পুরনো ট্যাংক আসার পর সেটিকে সম্পূর্ণ খুলে ১,০০০ ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়। এরপর প্রতিটি অংশের গায়ে এটি কোন ট্যাংক থেকে খোলা হয়েছে– তার চিহ্নিতকরণ লেভেল লাগিয়ে বিভিন্ন বিশেষায়িত ওয়ার্কশপে পরিষ্কার, মেরামত বা যন্ত্রাংশটি পরিবর্তনের জন্য পাঠানো হয়।
ট্যাংকের হাল বা মূল কাঠামোকেও পরিষ্কার করা হয়। এক্ষেত্রে শক্তিশালী স্প্রে দিয়ে পুরোনো রঙ বা মরিচা দূর করা হয়। সংস্কার হয় ইঞ্জিনও। ট্যাংকের প্রধান কামান ও টারেট ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা, লক্ষ্যবস্তুর দিকে সঠিকভাবে তাক করতে পারছে কিনা- ইত্যাদি চেক করার পর ঠিকঠাক করা হয়।
বিশেষায়িত একটি ওয়ার্কশপ শুধু ট্যাংকের বৈদ্যুতিক তার বদলানোর কাজই করে। প্রসঙ্গত, একটি আধুনিক ট্যাংকে যে পরিমাণ তার বা কেবল যুক্ত থাকে, সেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য এক মাইলের বেশি হতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে, প্রতিটি কারখানা মাসে ২০টি ট্যাংকের আধুনিকায়ন সম্পন্ন করতে পারে।
এরপর সব যন্ত্রাংশ জুড়ে দেওয়া হয় ট্যাংকটিতে। চাহিদা অনুসারে, বিভিন্ন যন্ত্র বা উপকরণের আপগ্রেড বা উন্নতরূপ স্থাপন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে আপগ্রেড প্রক্রিয়া ব্যাপক হয়। যেমন মূল ভার্সনের একটি টি-৭২ ট্যাংককে টি-৭২বি৩ মানে উন্নীত করতে হলে – ৭৮০ অশ্বশক্তির ইঞ্জিন বদলে ১১৩০ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন জুড়তে হয়। মূল কামান বদলে তার জায়গায় আরো উন্নত এমন কামান যুক্ত হয় – যা সাধারণ গোলার পাশাপাশি গাইডেড মিসাইলও ছুঁড়তে পারে। ট্যাংকের সুরক্ষা আরো দৃঢ় করতে যুক্ত হয়- এক্সপ্লোসিভ রিঅ্যাক্টিভ আর্মারের ব্লক। ক্রু কম্পার্টমেন্টে ট্যাংকের কমান্ডারের জন্য থার্মাল ইমেজিং সাইট, ডিজিটাল ইনক্রিপটেড রেডিও, গানারের জন্য ব্যালেস্টিক কম্পিউটার-সহ অত্যাধুনিক সব উপকরণ যুক্ত হয়।
এই আপগ্রেড প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ভঙ্গুর পুরোনো ট্যাংক রূপ নেয় আধুনিক সাঁজোয়া যানে। সম্পূর্ণ নতুন ট্যাংক তৈরির চাইতে এটি বেশ সস্তা উপায়। তাত্ত্বিকভাবে, প্রতিটি কারখানা মাসে ২০টি ট্যাংকের এমন আধুনিকায়ন সম্পন্ন করতে পারে। ফলে সবগুলো কারখানা থেকে মাসে ১২০টি ট্যাংক যুক্ত হতে পারবে রুশ সেনাবাহিনীতে।
অর্থাৎ, বিটিআরজেডগুলো রাশিয়াকে বড় এক সুবিধা দিচ্ছে। সে তুলনায়, ইউক্রেনের একমাত্র ট্যাংক কারখানাটি গত বছর যুদ্ধের শুরুর দিকেই ধবংস হয়েছে। একারণে, মিত্রদের কাছে আরো ট্যাংক চাইছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তবে এপর্যন্ত সীমিত সংখ্যক পশ্চিমা ট্যাংক পেয়েছে কিয়েভ। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ অল্পসংখ্যক ট্যাংক দেওয়ারই ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন ট্যাংকের ধারাবাহিক সরবরাহ থাকবে বলেই আশা করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেও রুশ ট্যাংক বহরের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তারপরও, শক্তিক্ষয়ের এ চূড়ান্ত লড়াইয়ে আখেরে বিজয়ী হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও এজন্য দিতে হয় চড়া মূল্য। জার্মানির চেয়ে সোভিয়েত বাহিনীর ট্যাংক ধবংস হচ্ছিল অনেক বেশি। বলা হয়, যুদ্ধকালে কার্যত তিনবার ধবংস হয়েছিল সোভিয়েত ট্যাংক বহর। কিন্তু, যত ট্যাংক ধবংস হচ্ছিল যুদ্ধের ময়দানে, তার চেয়েও দ্রুত গতিতে পৌঁছে যাচ্ছিল সংস্কার করা বা নতুন ট্যাংক। এসময় ধবংসপ্রাপ্ত ট্যাংক সংস্কারে অসম্ভবকে সম্ভব করে বিটিআরজেডগুলো। বর্তমান সংঘাতের সময়েও একই রকম ফলাফল তাদের থেকে চাইছে ক্রেমলিন। এভাবে রাশিয়া যুদ্ধ অব্যাহত রেখে– কবে পশ্চিমা দুনিয়া হাল ছেড়ে ইউক্রেনের পেছন থেকে সরে যায়, সেই অপেক্ষা করতে পারবে।
যুদ্ধকালীন ঘাটতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা অবশ্য যথার্থ নয়। বিশ্বযুদ্ধকালে আর্কটিক কনভয়ের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দরকারি কাঁচামাল, শিল্প উপকরণ, যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল পশ্চিমারা। যেমন সোভিয়েত ট্যাংক নির্মাণে দরকারি ৩৮ হাজার লেদ মেশিনসহ ও অন্যান্য ধরনের ধাতু শিল্পের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে, বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব, যার ফলে ট্যাংক নির্মাণে দরকারি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ পেতে সমস্যাই হচ্ছে রাশিয়ার।
ড্রুমন্ড বলেন, "রিঅ্যাক্টিভ আর্মার, আধুনিক অপটিক্স এবং সিফোরআই (কম্যান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন্স ও ইন্টেলিজেন্স) সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়তো দুষ্কর হবে না, কিন্তু এগুলোর যথেষ্ট সরবরাহ পাওয়াই মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।"
সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে পারে সেমিকন্ডাক্টর বা কম্পিউটার চিপ সরবরাহ নিয়ে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকায় এরমধ্যেই এর সংকট দেখা দিয়েছে রাশিয়ার মোটরকার নির্মাণশিল্পে। বাধ্য হয়েই বিভিন্ন মডেলের গাড়ি ডাউনগ্রেড করছে তারা। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে লাডা গ্রান্টা সাবকম্প্যাক্ট গাড়িতে যুক্ত হয়নি আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স, নেই এয়ারব্যাগ। ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিটকেও 'সরলীকরণ' করতে হয়েছে।
কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সামরিক সরঞ্জামের জন্য ওয়াশিংমেশিন আমদানির পর সেখান থেকে মাইক্রোচিপ খুলে নিতে হচ্ছে রুশ উৎপাদকদের। চিপ সংকটে কিছুকাল ইউভিজেড কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল বলেও ইউক্রেনীয় সূত্রগুলো দাবি করে।
এদিকে ইউক্রেন রণাঙ্গনে তোলা কিছু ছবিতে পুরনো ও নতুন রাশিয়ান উপকরণের মিশ্র উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান ট্যাংকে। কোনো কোনোটির হয়তো উন্নতকরণ অর্ধেক হয়েছে, ফলে কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সেগুলোতে নেই। যেমন পুরনো অপটিক্যাল সাইট-যুক্ত টি-৭২ ট্যাংকের দেখা মিলছে। নিশানা ঠিক করতে দরকারি উইন্ড সেন্সর বা বায়ুপ্রবাহমাপক যন্ত্র এর কোনো কোনোটিতে নেই বলেও জানা যাচ্ছে। কিছু ট্যাংকে আবার নেই এক্সপ্লোসিভ রিঅ্যাক্টভ আর্মার, ফলে এগুলো পুরোনো ধরনের ট্যাংক-বিধবংসী অস্ত্রের মুখে বিপন্ন হবে।
পুরোনো ট্যাংক বনাম নতুন ট্যাংক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি উন্নত রণসরঞ্জাম উৎপাদনে জোর দেয়। প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য মানের চেয়ে বেশি সংখ্যায় অস্ত্র উৎপাদনেই গুরুত্ব দেয়। এবিষয়ে স্টালিনের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল – পরিমাণেরও নিজস্ব মান রয়েছে। তাই সোভিয়েত শিল্পকে যত বেশি সম্ভব যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদনের নির্দেশ দেন তিনি, সেক্ষেত্রে মানের দিকে ততোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
ড্রুমন্ডের মতে, সেটি আজো কিছুক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন পুরোনো টি-৬২ ট্যাংককে পদাতিক বাহিনীর সহায়ক অপারেশনে বর্মসজ্জিত কামান হিসেবে ব্যবহার করা যেতেই পারে। তবে আধুনিক ট্যাংকের মুখোমুখি হলে তারা বিপদেই পড়বে।
ডিপো থেকে এনে ইউভিজেড যেসব পুরোনো টি-৬২ ট্যাংকের সংস্কার করছে, তার সাথে তাদের উৎপাদিত সর্বাধুনিক টি-৯০ ট্যাংকের তুলনা করলে– এটি আরও স্পষ্ট হবে। যেমন গোলা ছুঁড়তে টি-৯০ ট্যাংকের রয়েছে সর্বাধুনিক মডেলের ১২৫ মিলিমিটার কামান, যা সাত কেজি ওজনের গোলা প্রতি সেকেন্ডে ১,৮০০ মিটার গতিতে নিক্ষেপ করতে পারে। সে তুলনায়, ১১৫ মিলিমিটার কামান-সজ্জিত টি-৬২ ট্যাংকের কামান পাঁচ কেজি ওজনের গোলা ১,৬০০ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ছুঁড়তে পারে। বর্তমান পশ্চিমা প্রযুক্তির ট্যাংকের তুলনায় যা অনেকটাই নিম্ন-সক্ষমতা।
ড্রুমন্ড বলেন, "ট্যাংক বনাম ট্যাংকের যুদ্ধে, টি-৬২ সহজেই লেপার্ড-২ শ্রেণির কোনো ট্যাংকের কাছে হেরে যাবে। কারণ, ইউক্রেনকে দেওয়া লেপার্ড-২ ট্যাংক রাশিয়ান টি-৬২ ও টি-৭২ ট্যাংকের কামানের পাল্লার বাইরে থেকেই সেগুলোর ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে পারে।"
সে তুলনায়, টি-৯০এম ট্যাংকে রয়েছে কয়েক স্তরের উচ্চপ্রযুক্তি সম্পন্ন সুরক্ষা ব্যবস্থা। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো – অ্যাকটিভ প্রটেকশন সিস্টেম (এপিএস), যা শত্রুর গোলা ধবংস করতে তার দিকে প্রতিরোধকারী গোলা নিক্ষেপ করে। এরপরের স্তরে রয়েছে, এক্সপ্লোসিভ রিঅ্যাক্টিভ আর্মার, যাতে আঘাত হানলে এপিএসকে ফাঁকি দিয়ে আসা গোলা হয় বিস্ফোরিত হয়, নাহলে তার বর্মভেদের শক্তি ক্ষয় হয়। সর্বশেষ সুরক্ষা হিসেবে থাকে ট্যাংকের নিজস্ব বর্ম – যা ইস্পাত, সিরামিক ও কম্পোজিট উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। সে তুলনায়, টি-৬২ ট্যাংকের রয়েছে মৌলিক ইস্পাত-নির্মিত বর্ম, যার সুরক্ষা বেশ সীমিতই বলা যায়।
তবে টি-৬২'র একটি বিশেষ সুবিধা আছে। যেমন আধুনিক রুশ ট্যাংকগুলোয় কামানে গোলা ভরার কাজ করে অটো-লোডার যন্ত্র, যা প্রায়ই শত্রুর গোলার আঘাতে বিস্ফোরিত হয়। টি-৬২ ট্যাংকে এটি নেই।
ড্রুমন্ডের মতে, "এই যুদ্ধের জন্য হয়তো টি-৬২ ট্যাংকই ভালো, কারণ ক্রু কমার্টমেন্টে গোলা না থাকায় এটি মারাত্মকভাবে বিস্ফোরিত হওয়ার ঝুঁকিও তুলনামূলকভাবে কম।"
তাছাড়া, নানান রকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকার পরও বর্মভেদী আধুনিক অস্ত্রের সামনে টি-৬২ ট্যাংকের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত নয় টি-৯০। মিলার বলেন, "যেমন ধরুন জ্যাভেলিন মিসাইলের সামনে সব রাশিয়ান ট্যাংকই অসহায়।"
এছাড়া, বিটিআরজেড-গুলো যে হারে ট্যাংক আধুনিকায়নের দাবি করছে, বাস্তবেও সে হারে হচ্ছে কিনা – এনিয়ে প্রশ্ন তোলেন মিলার।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে এমন ধারণা ড্রুমন্ডেরও।
তিনি বলেন, "উপকরণের যোগান নিয়ে বাধা থাকায় – এই হারে আধুনিকায়ন করাটা বেশ কঠিন হবে। তারপরও যদি মাসে তারা ২০টি ট্যাংক সংস্কার করতে পারে, তাহলে বলতে হয় তারা ভালোই করছে।"
প্রায় ৮০০ টি-৬২ ট্যাংক সংস্কার করে ইউক্রেনে পাঠানোর পরিকল্পনা আছে রাশিয়ার। এরমধ্যে অনেক ট্যাংক ৭০' এর দশকে তৈরি, যেগুলোর ব্যাপক আধুনিকায়ন দরকার হবে। তবে এমনটাও হতে পারে, কোনোরকমে সেগুলোকে সচল করেই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে। এই প্রেক্ষাপটে, টি-৬২ ট্যাংক মোতায়েন রাশিয়ার আপ্রাণ চেষ্টার প্রমাণ হলেও – সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৪০ ও ৫০ এর দশকে তৈরি টি-৫৪ ট্যাংকও ইউক্রেনে পাঠানোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে শত্রুর সামনে শুধু ব্যাপক সংখ্যায় সাঁজোয়া যান মোতায়েন করাই যথেষ্ট হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাখ্যা করে ড্রুমন্ড বলেন, "এটা উল্লেখ করা জরুরি যে, এসব ট্যাংক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লজিস্টিকস সমর্থনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু, তা নেই। ফলে রাশিয়ার এসব পুরোনো ট্যাংক মোতায়েনের সক্ষমতা ব্যাহত হবে।"
বিজয়ের মূলমন্ত্র
শত্রুর বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমণ অভিযানের সময় সম্মুখভাগে থাকে ট্যাংক বা সাঁজোয়া বহর। তবে আধুনিক যুদ্ধের জন্য এমন শক্তিশালী সাঁজোয়া বাহিনীর দরকার, যেমনটা ১৯৯১ বা ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের সময় পশ্চিমাদের কাছে ছিল। ইরাকের আকাশে পশ্চিমা বিমান শক্তির আধিপত্যও ইরাকি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়। স্থল ও আকাশে এই ধরনের শক্তির ব্যবহার ছাড়া – রাশিয়া খুব বেশি সুফল পাবে না। বরং বাখমুতের যুদ্ধের মতোন অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এই অবস্থায় প্রতিরোধমূলক অবস্থানে থাকাই হবে রাশিয়ার পক্ষে সুবিধেজনক।
এদিকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপ-মন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ দাবি করেছেন, চলতি বছর রাশিয়া ১,৫০০ ট্যাংক উৎপাদন করবে – যা অতিরঞ্জিত সংখ্যা বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
তবে ইউক্রেনীয় আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ট্যাংকের সংখ্যাধিক্য সুবিধা দেবে রাশিয়াকে। পুরোনো ট্যাংককে দূর থেকে গোলাবর্ষণের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। দিনশেষে এই লড়াইও শক্তিক্ষয়ের চূড়ান্ত সংগ্রাম – যেখানে বিজয়ী কে হবে, তা নির্ভর করবে সম্পদের সঠিক ও উদ্ভাবনী ব্যবহারের ওপর।