ইউক্রেনে লড়াই চলমান অবস্থায় শান্তি আলোচনার কথা যেন নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়েছে
রাশিয়ার সম্পূর্ণ পরাজিত নাহলে- ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে মুখ খুলে বিপদে পড়েছেন ন্যাটো মহাসচিবের চিফ অব স্টাফ স্টেইন ইয়ানসেন।
নরওয়েতে এক প্যানেল আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, 'এমনটাই হবে আমি তা বলছি না; কিন্তু যদি হয়, তাহলে কিছু ভূখণ্ডের দাবি ছেড়ে দেওয়াই ইউক্রেনের জন্য একটি সমাধান হতে পারে। বিনিময়ে তারা ন্যাটো সদস্যপদ পাবে।'
তিনি আরো বলেন, 'ইউক্রেন কখন ও কোন শর্তের ভিত্তিতে আলোচনা করতে চাইবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকা উচিত।' শেষের এই কথাটি ন্যাটোর পক্ষ থেকে আগেও নানানভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এই আলোচনা গুরুতর কিছু ছিল না।
কিন্তু, তাতে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে। ইয়ানসেনের বক্তব্যে ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন ইউক্রেনীয়রা। সমালোচনার মুখে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন তার ঊর্ধ্বতন- জেনস স্টলটেনবার্গ, এবং শেষপর্যন্ত ইয়ানসেনকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার বিষয়ে কিছু বিশ্লেষক বলছেন, কূটনৈতিক প্রচেষ্টার চিন্তাভাবনা যখন সবচেয়ে বেশি দরকার, ঠিক তখনই আবেগ-তাড়িত হয়ে ইয়ানসেনের নিন্দা করা হয়েছে। এনিয়ে জনপরিসরে আলোচনা করাও যে নিষিদ্ধ বিষয়ে রূপ নিচ্ছে, এঘটনা তাই প্রমাণ করে।
সামাজিক বিশ্বাস, ধ্যানধারণা বা আবেগের জন্য যা অস্বস্তিকর, তাই নিষিদ্ধ বিষয় বা ট্যাবু। পশ্চিমা মিত্র ও ইউক্রেনীরা কাউন্টার-অফেন্সিভের ওপরই অনেক বেশি আস্থা রাখছে। তাদের আশা, এই অভিযানের হাতে ধরে পাল্টাবে যুদ্ধের ভারসাম্য, রাশিয়ার দুর্বলতাগুলো প্রকাশ পাবে এবং যুদ্ধ-বিরতি আলোচনার জন্য মস্কো নমনীয় হতে বাধ্য হবে।
কিন্তু, ইউক্রেনের সেনারা দখলদার রুশ বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে, একথা ইউক্রেনের ঘোর সমর্থকরাও বলছেন না। কাউন্টার অফেন্সিভের সামান্য অগ্রগতি ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধে এ ধরনের লক্ষ্য অর্জন আরো সুদূর পরাহত হয়ে উঠছে।
রাশিয়া বা ইউক্রেন কোনো পক্ষকেই বর্তমানে সংলাপের জন্য আগ্রহী মনে না হলেও – এসব কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে কি করা দরকার– সে প্রশ্ন তুলছেন। তারা মনে করেছেন, করণীয় ঠিক করতে অন্তত এবিষয়ে আলোচনা থাকা দরকার। আরেকদল বিশ্লেষক ও কর্মকর্তা আবার মনে করেন, সংলাপ শুরু করলে তাকে দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারে মস্কো।
তবে এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বলছেন, আলোচনার মাধ্যমেই এ যুদ্ধের অবসান হবে এমন সম্ভাবনা আছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড কর্পোরেশনের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্যামুয়েল চারাপ মনে করেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজেই এধরনের আলোচনা কিভাবে শুরু হবে– তা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক থাকা উচিত।
বাইডেন প্রশাসন গোপনে রাশিয়ার সাথে আলোচনা শুরু করেছে এনিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সমর্থকরা সমালোচনাও করছেন। যা নতুন মাত্রা পেয়েছে সাবেক মার্কিন কূটনৈতিক থমাস ই. গ্রাহামসহ দুই ব্যক্তির সাথে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের গোপন আলোচনার সূত্রে। জানা গেছে, যুদ্ধ অবসানের সম্ভাব্য নানান উপায় নিয়েই তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।
এই সংলাপের ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে, প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। ল্যাভরভের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ওই তিন ব্যক্তি কিছু না বলতে চাইলেও – তাদের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই তা প্রকাশ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা চার্লস এ. কুপচান।
ওয়াশিংটন ও কিয়েভের মধ্যে সব ক্ষেত্রেই স্বার্থের সামঞ্জস্য নেই। একইসঙ্গে, সংলাপের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করতে যে রাশিয়ার সাথে আলোচনার গুরুত্ব আছে– এ ঘটনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'প্ল্যান বি (বিকল্প পরিকল্পনা) নিয়ে যেকোনো আলোচনাই যে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হবে, ইয়ানসেন সেটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বুঝতে পারলেন। যারা সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন – তাদের নিন্দা ও গালাগালি করা হচ্ছে। এই বিষয়টি আগেও ট্যাবু ছিল, এখন যেন তা আরো উচ্চপর্যায়ের নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।'
তবে কাউন্টার-অফেন্সিভ ভালোভাবে না চললে –এখনই বিকল্প উপায় সন্ধান করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন কুপচান। তার মতে, এই নিন্দা এড়াতে ন্যাটো মহাসচিব স্টলটেনবার্গ-সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা 'প্রয়োজনে যতদিনই লাগুক' ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া হবে– এমন কথা আরো জোর দিয়ে বলছেন।
শান্তি আলোচনার জন্য দুই পক্ষের থেকেই সংলাপের উদ্যোগ থাকা দরকার। কিন্তু, বর্তমানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বা রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন –কেউই কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য সম্মত নন।
পুতিনের বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ধরে রাখতে পেরেছে। বেশিরভাগ বিশ্লেষকের মতে, পুতিন মনে করছেন, এক পর্যায়ে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরবেন বলেও আশা করতে পারেন তিনি।
ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে একদিনের মধ্যেই এ যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। তিনি প্রেসিডেন্ট পুনঃনির্বাচিত না হলেও, রিপাবলিকানদের মধ্যে তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যা কাজে লাগিয়ে তিনি কিয়েভকে সহায়তা দান সীমিত করার চাপ দিতে পারেন।
যুদ্ধে ইউক্রেনীয়রা যথেষ্ট বলিদান করেছেন, এত ক্ষয়ক্ষতির পর সংলাপের বিষয়ে জেলেনস্কির রাজনৈতিক শক্তি কতটুকু আছে– সেটাও প্রশ্নের সম্মুখীন। এমনকী রুশ সেনাদের ২০২২ সালের আগ্রাসনের আগের অবস্থানে পিছু হঠানো সম্ভব হলেও– শান্তি আলোচনার জন্য জেলেনস্কিকে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হবে।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক টুইটার (বর্তমানে এক্স) লিখেছেন, 'ন্যাটোর সুরক্ষা পেতে ভূখণ্ড বিসর্জন? এই চিন্তাও হাস্যকর। এর অর্থ– স্বেচ্ছায় গণতন্ত্রের পরাজয় স্বীকার, বিশ্বের এক অপরাধীকে উৎসাহিত করা, রাশিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষা, আন্তর্জাতিক আইনকে ধবংস করে এই যুদ্ধকে অন্য প্রজন্মগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া।'
জার্মান কর্মকর্তারাও সংলাপের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান চান। রাশিয়াকে কিভাবে আলোচনার টেবিলে ফেরানো যায়, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কথাবার্তাও হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তক সংস্থাগুলোর বিশ্বস্ত বিশেষজ্ঞদের সাথে তারা গোপনে এই আলোচনা করছেন, যাতে রাশিয়া এটাকে দুর্বলতার লক্ষণ না মনে করে।
তবে অনন্তকাল এই যুদ্ধ চালিয়ে না যাওয়ার বিষয়ে বার্লিন ও ওয়াশিংটনের আগ্রহ আছে। কারণ, ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তার পেছনে আইনপ্রণেতাদের সমর্থন কমছে। বিশেষ করে, ডান ও কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা এর বিরোধিতা করছেন। তাদের পেছনে জনসমর্থনও বাড়ছে।
অন্য অনেকেই মনে করেন, রাশিয়ার সাথে সংলাপের মাধ্যমে সংঘাতের অবসানের বিকল্প পরিকল্পনা 'অনৈতিক' এবং এখনই তার প্রকৃত সময় নয় বলে মন্তব্য করেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ কনস্টাঞ্জ স্টেলজেনমুল্যার।
তিনি বলেন, পুতিন সংলাপের বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখাননি, তার আশেপাশের অপেক্ষাকৃত নবীন প্রজন্মের কর্মকর্তারা তার চেয়েও বেশি কট্টরপন্থী।
তাই পশ্চিমা বিশ্বের কেউ যখন এসব ব্যক্তির সাথে আলোচনার কথা তুলছেন, তখন তাদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। 'পুতিন ইতঃপূর্বে অনেকবার বলেছেন, নিজের ছাড়া তিনি অন্য কারো শর্তে আলোচনা করবেন না। আর তার লক্ষ্য হচ্ছে, ইউক্রেনকে ধবংস করে দেওয়া। এ বিষয়ে স্পষ্টতার কোনো কমতি নেই।'
স্টেলজেনমুল্যারের মতে, গ্রহণযোগ্য কোনো বিকল্প শান্তি পরিকল্পনা আসতে হবে – চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ইন্দোনেশিয়ার মতো অপশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে – যাদের সাথে রাশিয়ার নির্ভরশীলতা আছে।