ইউক্রেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে চায়, কিন্তু তা হবে শুরুমাত্র, সামনে আরও ভয়ঙ্কর লড়াই
নিজ দেশের দক্ষিণে রুশ সেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করার এক মরণ সংগ্রামে লিপ্ত ইউক্রেনের সেনারা। কিন্তু, একাজে তারা যদি সফলও হয়– তা হবে কেবল শুরুমাত্র। সত্যিকার অর্থেই বড় অর্জনের নাগাল পেতে হলে– এরপরে তাদের রুশ বাহিনীর ঘেরাও ছিন্ন করে এগোতে হবে।
কাউন্টার অফেন্সিভ শুরুর পর– গত জুন থেকেই রুশ বাহিনীর পরিখা, পেতে রাখা মাইনসহ নানান রকম প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনাদের; আগের কয়েক মাস ধরে এসব বাধা নির্মাণ করেছে রুশ বাহিনী।
রাশিয়া এই প্রতিরোধ ভাগের নাম দিয়েছে 'ফরওয়ার্ড সিকিউরিটি জোন'। গত কয়েক সপ্তাহে ইউক্রেনীয়রা এরমধ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি করেছে। বিশেষভাবে অগ্রগতি হয়েছে রবোতিনের কাছে, এখন তারা নিকটবর্তী জনপদ ভারবোভের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু, ভারবোভে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে রুশ বাহিনীর।
ভারবোভ দখল কঠিন হবে, এমন ইঙ্গিত মিলছে। তবু কিয়েভ বাহিনীর এই অগ্রগতিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কর্মকর্তারা। যাদের অনেকেই আরও আক্রমণাত্মকভাবে অভিযান না চালানোয় ইতঃপূর্বে কিয়েভের সমালোচনা করেছিলেন। যদিও, ইউক্রেনীয় সেনাদের সামনে এখন যে কঠিন চ্যালেঞ্জ, তাতে করে ইউক্রেনের একান্ত সমর্থকরাও চিন্তামুক্ত থাকতে পারছেন না।
রাশিয়া শুধু মারাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেনি – বাড়তি সেনা পাঠিয়ে তা আরও শক্তিশালী করছে।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দক্ষিণে আরও সেনাকে সরিয়ে এনেছে রাশিয়া।
রাশিয়ার নজরদারি ফাঁকি দিতে– ইউক্রেনীয় সেনারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। এভাবে তারা প্রতিরোধ কাঠামোর বিভিন্ন জায়গাকে শত্রুমুক্ত করতে চাইছে, যাতে পরে সাঁজোয়া বাহিনী এসে প্রতিরোধ সারিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এগুতে পারে।
আক্রমণকারীরা সেনারা যা তৈরি করতে চাইছে, তাকে সামরিক কৌশলবিদরা বলেন 'স্যালিয়েন্ট' বা সম্মুখব্যূহ। শত্রু বাহিনীর সম্মুখভাগে হামলার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা জুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যার লক্ষ্য। এতে শত্রুর সম্মুখভাগে একটি শূন্যতা তৈরি হয়। ভারী অস্ত্রে (ট্যাংক, সাঁজোয়া যান) সজ্জিত মিত্র সেনারা এই জায়গাটি থেকে পরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, এবং আরও এগিয়ে যায়।
এভাবে ধাপে ধাপে রুশ বাহিনীর পেছনের সারির দিকে এগুনোর উদ্দেশ্য আছে তাদের।
রুশ প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করার প্রচণ্ড কঠিন কাজটি যদি ইউক্রেনীয়রা করতেও পারে– এরপরে তাদের শত্রুমুক্ত অবস্থানটির দখল ধরে রাখতে হবে, এবং তা আরও সম্প্রসারণের চেষ্টা করতে হবে। কেবলমাত্র তাহলেই সাঁজোয়া বাহিনীর এগুনোর মতো জায়গা তৈরি হবে। এভাবে এক পর্যায়ে শত্রুর ঘেরাও মুক্ত হয়ে উল্টো তাদের ঘেরাও করার মতো অবস্থান তৈরি হবে। মস্কোর সেনারা এমন পরিস্থিতি রুখতেই লড়ছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মার্ক কিমিত বলেন, 'প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করে (ব্রেকথ্রু) সেনারা সামনে এগুনোর সুযোগ পায়, কিন্তু তারপর শত্রুর ঘেরাও মুক্ত হতে (ব্রেকআউট) আরও লড়াই করতে হয়। শত্রু সামান্যতম যোগ্য হলে, বা তাদের কাছে এই সম্মুখব্যূহে পাল্টা-আক্রমণ চালানোর মতো পর্যাপ্ত সেনা ও রসদ থাকলে– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।'
রবোতিনের কাছে ইউক্রেনীয় সেনাদের অগ্রযাত্রা রুখতে ইতোমধ্যেই তাদের ওপর পাল্টা-আক্রমণ করছে রুশ সেনারা। তবে এই আক্রমণ স্থানীয়ভাবে সংগঠিত। মূল বাহিনীর পাল্টা-আক্রমণ এখনও আসেনি। একথা বলেছেন, শহরটির উপকন্ঠে যুদ্ধরত ইউক্রেনের ৪৭তম ব্রিগেডের একজন প্ল্যাটুন কমান্ডার।
কলসাইন বা পোশাকি নাম- দোব্রো নামের ওই কমান্ডার জানান, রবোতিন থেকে ভারবোভ যাওয়ার রাস্তায় বিপুল পরিমাণ মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। রুশ সেনারা এই পথকে আগলাতে মরিয়া হয়ে লড়েছে। ভারবোভের দিকে এগুনোর অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওই প্ল্যাটুন কমান্ডার বলেন, 'আমাদের কঠিন অভিজ্ঞতা হয়, চারপাশে সবকিছু যেন বিস্ফোরিত হচ্ছিল।'
ইউক্রেনের সেনারা ভারবোভ দখল করতে বা এটি পাশ কাটিয়ে এগুতে পারলে– তারা আরও দক্ষিণে দেশটির কৃষ্ণসাগর উপকূলের দিকে অগ্রসর হবে। ভারবোভ থেকে যা মাত্র ৫০ মাইল দূরে। এখানে তাদের লক্ষ্য রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত করিডরকে দ্বিখণ্ডিত করা; যাতে ২০১৪ সালে অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সাথে রাশিয়ার নতুন করে দখলকৃত এলাকার যে স্থলসংযোগ আছে– তা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়।
বিশ্লেষক ও লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার পরবর্তী প্রতিরক্ষা সারি ভেদ করতে পারলে– তাদের আরও দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করবে– ওই অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট্য এবং রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু শক্তিশালী এ দুয়ের ওপর।
এদিকে রাশিয়াও পুরো পথে নানান রকম বাধা নির্মাণ করেছে। কিন্তু, কিছু জায়গা তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ফাঁকা রেখেছে, যাতে সেদিক দিয়ে ইউক্রেনীয়রা এগোয়। কিন্তু, তা করলেই ফাঁদে পড়বে তারা। রুশ কমান্ডাররা সুচতুরভাবে এমন কিছু 'কিল জোন' বা 'হত্যাক্ষেত্র' ঠিক করে রেখেছেন, যেখানে পৌঁছালে ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর সহজেই হামলা করা যাবে।
রণাঙ্গনের প্রায় প্রতিটি কোণায় হয় এভাবে ফাঁদ পেতেছে মস্কো, অথবা সেনা মোতায়েন করেছে। একারণে ফ্রন্টলাইনের সঠিক অবস্থান – ইউক্রেনীয় সেনাদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে সামনে কি আছে, সে সম্পর্কে তারা সঠিক আন্দাজ করতে পারছে না।
ইউক্রেনের একটি এয়ার-রিকনসেন্স ব্যাটালিয়নের সদস্য ও ড্রোন অপারেটর ওলেক্সান্ডার সোলোঙ্কো। বর্তমানে তিনি রবোতিনের কাছাকাছি এলাকায় ড্রোন পরিচালনা করেন। পাখির চোখে শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি দেখার সুযোগ পান।
ওলেক্সান্ডার জানান, 'গাছের প্রতিটি সারির পেছনে পরিখা রয়েছে। প্রতিটি ঝোপের আড়ালে রয়েছে শত্রুর অবস্থান।'
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মফস্বল তোকমাক- স্থানীয় রেল ও সড়ক যোগাযোগের কেন্দ্র। এখানে সেনাশক্তি বাড়াচ্ছে মস্কো। বিভিন্ন রকম প্রতিরক্ষার চাদরে শহরটিকে ঘিরে রাখা হয়েছে।
তোকমাকের নিকটবর্তী মেলিতোপোল শহরের সাবেক মেয়র (বর্তমানে তিনি নির্বাসিত) ইভান ফেদোরভ বলেন, 'প্রতিদিনই তোকমাক-সহ ফ্রন্টলাইনের নিকটবর্তী অন্যান্য শহরে আরও (রুশ) সেনারা আসছে। তোকমাক রুশদের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।'
রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী ইউক্রেনীয়দের সাথে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন ফেদোরভ। তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিদিনই তোকমাকে আর্টিলারি ও রকেট হামলা চালায়। গত সপ্তাহে তাদের গোলা একটি সামরিক গুদামে আঘাত হানে। এতে সেখানে রাখা গোলাবারুদে আগুন ধরে যায়, এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে একের পর এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়।
তোকমাকের প্রতিরক্ষা অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেনের সেনারা এই শহরকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো দুর্বল স্থানে আঘাত হানবে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কিমিত বলেন, এতে তারা যদি সফল হয়, তখন সম্মুখব্যূহের 'উভয় কাঁধ রক্ষা' করতে হবে। যাতে দখলকৃত জায়গায় তারা আরও সেনা ও রসদ সরবরাহকারীদের জড়ো করতে পারে। তারপর এই ফাঁকটি আরও বড় করতে হবে।
'একবার যদি কাঁধ রক্ষা করা যায় এবং সামনে যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শত্রুর বাধা না থাকে, তাহলেই সেনারা শত্রুর ঘেরাও থেকে ব্রেকআউট অর্জন করতে পারে'- বলেন তিনি।
ভারী অনেক যন্ত্রপাতি ও রসদ সরঞ্জাম আনতে হবে ইউক্রেনীয়দের। এরমধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ট্যাংক উদ্ধারকারী বিশেষায়িত যান। যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, গর্ত বা কাদায় আটকে গেলে- তা উদ্ধারে এসব যান ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের সামরিক পরিবহন মেরামতের জন্যও ভারী প্রকৌশল সরঞ্জামের দরকার আছে।
রবোতিনের এলাকায় যুদ্ধরত প্ল্যাটুন কমান্ডার দোব্রো জানান, ভূমিতে এত বেশি মাইন পেতে রাখা হয়েছে যে, যানবাহনের ক্ষতি হবেই। তাই ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে যথেষ্ট সংখ্যক মেরামতের সরঞ্জাম যেমন থাকতে হবে, তেমনই মাইন-বিধ্বংসী যন্ত্রপাতিও দরকার। 'এসব ইঞ্জিনিয়ার ও সরঞ্জাম আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।'
একইসঙ্গে, সম্মুখব্যূহ রচনার পরে রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে তাদের আর্টিলারি শক্তিকে দুর্বল করতে, যথেষ্ট পরিমাণ ভারী কামান ও মর্টার সেখানে আনতে হবে। শত্রুর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ, সুরক্ষিত অবস্থান থেকে শত্রু সেনাদের গুলিবর্ষণের মুখে এগোতে হবে ইউক্রেনীয়দের। রাশিয়ান বিমানবাহিনীও তাদের ওপর হামলা চালাবে। এই অবস্থায়, কামানের ডুয়েল চলাকালীন অবস্থাতেই তাদের এগোতে হবে।
শত্রুর ঘেরাও থেকে ব্রেক আউটের জন্য কয়েক মাস ধরে টানা গোলাবর্ষণ করতে হবে। সঙ্গে চাই শত্রুর দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করতে পদাতিক সেনাদের প্রোবিং অ্যাটাক। এসময়ে আক্রমণের অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ফ্রান্সের সৈকতে অবতরণের পর সম্মুখব্যূহ রচনা করেছিল মিত্রবাহিনী। কিন্তু, তারপরে টানা দুই মাস আকাশ ও স্থলপথে হামলা চালাতে হয়– নাৎসি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে ব্রেক আউট অর্জনে।
গুরুতর এই চ্যালেঞ্জের মুখে ইউক্রেনীয় সেনারা বলছেন, তাদের মনোবল অটুট আছে। দরকার হলে তারা এই বছরের শীতে, এমনকি আগামী বছরেও লড়াই চালিয়ে যাবে। তাদের মতে, রাশিয়াকে এমন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ার সময় দেওয়াটা বড় ভুল ছিল; এখন আর তা করা যাবে না। বরং রুশ বাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ সম্পর্কে গবেষণা করেছেন ফিনল্যান্ডের একজন ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক পাসি পেরোইনেন। তিনি বলেন, 'ইউক্রেনীরা যদি ব্রেক থ্রু না পায়, আরও পরিখা খুঁড়তে বা পাল্টা-আক্রমণ চালাতে রুশদের সামনে কোনো বাধাই থাকবে না।'