গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ অভিযানে ইউক্রেনের কঠিন শিক্ষা
যুদ্ধের বাস্তবতা হলিউডের চলচ্চিত্রের মতোন নয়, বরং অনেক বেশি নির্মম। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির বক্তব্যে ছিল তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত। তিনি বলেন, 'লোকজন তাৎক্ষণিক ফলাফল প্রত্যাশা করছে। বিষয়টি বোধগম্য, কিন্তু এটা কোনো ফিচার মুভি নয়– যেখানে সবকিছু দেড় ঘণ্টার মধ্যে ঘটবে।'
যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান পরিস্থিতি তার কথাকে সমর্থন করে। কোনো প্রকার বিমানশক্তি ছাড়াই ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে বলে যে আশা করা হচ্ছিল – তা যে বাস্তবতা-বর্জিত, হলিউড চলচ্চিত্রের প্লটের মতোন নাটকীয় – সেটা এখন কিয়েভের মিত্ররাও বুঝছে।
পাল্টা-আক্রমণ অভিযান (কাউন্টার-অফেন্সিভ) শুরুর তিন মাস পরে এসে জেলেনস্কি ও তার সরকারের দায়িত্বশীলরাও বুঝছেন, এতে প্রত্যাশিত ফল আসেনি। এখন তাদের আরও দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহে নিজ দেশের দক্ষিণে ধীর গতিতে হলেও, উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনীয় সেনারা। এরমধ্যে রাশিয়ার প্রথম প্রতিরোধ সারি ভেদ করাটা অন্যতম। তবে পশ্চিমা মিত্র সরকারগুলোর কোনো কোনো কর্মকর্তা আফসোস করে বলছেন, তাদের দেওয়া অস্ত্র ও সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সমর্থনের সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে কিয়েভ।
সামান্য এই অর্জনের ফলে – সামরিক কৌশল নিয়ে কিয়েভের সাথে পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতপার্থক্য বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ব্যক্তিগত-পর্যায়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, প্রশিক্ষণকালে মেকানাইজড ইনফেন্ট্রি, আর্টিলারি ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সমন্বয় করতে পারেনি ইউক্রেন, তাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে ঝুঁকিগুলো প্রকৃতঅর্থে আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে সঠিক প্রস্তুতি নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এসব ঘাটতির ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো – ইউক্রেনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব বিমান শক্তির আধিপত্য ছাড়া – মার্কিন সেনারা কখনো রাশিয়ার মতো বৃহৎ ও শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির মোকাবিলাও করতে হচ্ছে।
ভিক্টর নামে ইউক্রেনের একটি গোলন্দাজ ইউনিটের ব্যাটারি কমান্ডার বলেন, 'এম-৭৭৭ হাউইটজার কামান দিয়ে ৫ থেকে ৭ হাজার রাউন্ড গোলা ছুঁড়েছেন– আমাকে এমন একজন মার্কিন অফিসার বা সার্জেন্ট দেখান।' পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধরত এই কমান্ডার অবশ্য স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এই কামান দিয়ে তারা আরও নির্ভুলভাবে রুশ সেনাদের অবস্থানে হামলা করতে পারছেন।
এদিকে গত সপ্তাহের রোববার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মিলি বিবিসিকে জানান, ইউক্রেনীয় সেনারা এখন অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু, শরৎকাল আসার আগে তাদের হাতে খুব বেশি হলে এক মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় সপ্তাহ সময় আছে। এরমধ্যেই কাউন্টার অফেন্সিভের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। কারণ তারপরই শরৎকালীন বৃষ্টি নামবে ইউক্রেনে। এই বৃষ্টিতে আঠালো, কর্দমাক্ত ভূমিতে রূপ নেয় ইউক্রেনের জমি। তখন সাঁজোয়া যানসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরেই আবার শুরু হবে হাড় কাঁপানো শীত।
কিন্তু, এ ধরনের মন্তব্যে বিরক্ত হয়েছেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। দক্ষিণ ইউক্রেন - যেখানে কাউন্টার অফেন্সিভ চলমান – সেখানকার জমি তুলনামূলকভাবে শুস্ক। এ অঞ্চলে শীতের প্রকোপ দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে কম বলেও উল্লেখ করেন তারা।
গত শনিবার ইয়াল্টা ইউরোপিয়ান স্ট্র্যাটেজি সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইউক্রনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল কিরিলো বুদানভ বলেন, 'আমরা বর্ষাকালে আফ্রিকায় অভিযান চালাচ্ছি না।'
পশ্চিমা মিত্রদের দাবি অস্বীকার, ক্ষেত্রবিশেষে কখনো কখনো তাদের একহাত নেওয়ার এই রেওয়াজ তারা চালিয়ে গেলেও– ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে শুরু করেছেন। তারা বুঝতে পারছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায় হবে।
এদিকে নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে ইউক্রেনকে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছে পশ্চিমারা। দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামে তারা একইভাবে কিয়েভের পাশে থাকবে কিনা– সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
কাউন্টার অফেন্সিভের শুরুতেই বিপুল পরিমাণ ইউক্রেনীয় সেনা হতাহত হয়। কিয়েভ বুঝতে পারে, এ সংখ্যায় সেনার ঘাটতি পূরণ তাদের পক্ষে অসম্ভব। এরপর শত্রুর শক্তিক্ষয়ের কৌশল নেয় কিয়েভ। যুদ্ধের সম্মুখভাগে আর্টিলারি ব্যবহার করে শত্রুর রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ধবংস করে তাদের দুর্বল করার চেষ্টা চালায়। একইসঙ্গে, রুশ সেনাদের অবস্থানগুলো দখলে– ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে হামলা করে ইউক্রেনের পদাতিক সেনারা।
ন্যাটোর কিছু কর্মকর্তার এ কৌশল নিয়ে উদ্বেগ আছে। তারা মনে করছেন, পুরোনো সোভিয়েত ধ্যানধারণার বশবর্তী হচ্ছেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। তবে চলতি গ্রীষ্মের অভিযান সম্পর্কে অধ্যয়নকারী ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলেছেন, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার ভিত্তিতেই এ কৌশল নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে এটি মানানসই। কারণ রাশিয়া ভারী প্রতিরক্ষা কাঠামো নির্মাণ করেছে, সম্মুখভাগজুড়ে ঘন করে বেছানো রয়েছে মাইন। তাছাড়া, বিমানশক্তির সাহায্য ছাড়াই ইউক্রেনীয়দের লড়তে হচ্ছে। আবার ড্রোনের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের গতিবিধি আড়াল করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেনের নতুন কৌশলটি কিছু সাফল্যও পেয়েছে, তবে এতে রুশ প্রতিরোধ সহসাই ভেঙ্গে পড়বে না, বরং অনেক সময় লাগবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো– শক্তিক্ষয়ের এ কৌশলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নির্ভর করবে ইউক্রেনের মিত্রদের গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম উৎপাদন সক্ষমতার ওপর।
সামরিক বিশ্লেষক রব লি এবং মাইকেল কফম্যান কাউন্টার অফেন্সিভ নিয়ে তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন, 'ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কীভাবে যুদ্ধে লড়ে, এবং কোন পরিস্থিতিতে তাদের লড়তে হচ্ছে – সে সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করার ফলেই অযাচিত প্রত্যাশা করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমা অনেক সামরিক কর্মকর্তারা অন্যায্য সমালোচনা করছেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত উপদেশ দিচ্ছেন।'
তবে অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতো তারাও বলেছেন যে, ইউক্রেনকে অবশ্যই তাদের চলমান কাউন্টার-অফেন্সিভের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে; যাতে আগামী বছর বা তারও পরে– হাজার মাইলের বেশি বিস্তৃত ফ্রন্টলাইন থেকে রুশ সেনাদের পিছু হঠানো সম্ভব হয়। একইসঙ্গে তারা আরও মনে করেন যে, ইউক্রেনকে দেওয়া সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি পশ্চিমা মিত্রদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে; প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন না হওয়ার পেছনে এটিও ভূমিকা রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর নেতারা বারবার বলেছেন, রুশ বাহিনীকে পরাজিত করতে যত সময়ই লাগুক, তারা ইউক্রেনের পাশেই থাকবেন। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে– ইউক্রেনকে যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে ভবিষ্যতে তাদের আরও নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কৌশলগত কমান্ডের প্রধান জেনারেল জেমস হকেনহাল বলেন, ইউক্রেনের আক্রমণ অভিযান 'একবার'ই করা সম্ভব এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। এর মাধ্যমে আগামীতেও ইউক্রেন আক্রমণ অভিযান চালাতে পারবে, এই বার্তা দিলেন তিনি। তবে তিনি এ-ও বলেছেন যে, কিয়েভের মিত্রদের গোলাবারুদ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রাখাটা অপরিহার্য। হকেনহালের মতে, 'একাজে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে (ইউক্রেন)।'