ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়তে যেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে এক মশকবাহিনী
আমেরিকা মহাদেশে ডেঙ্গু এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত পাঁচ দশকের মধ্যে ২০২৩ সালে এ মহাদেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড সাড়ে ৩৩ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন এক হাজার ৫৬৭ জন। মেক্সিকো, বলিভিয়া, পেরু ও ব্রাজিলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
এডিস এজিপ্টি মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগ হয়। জমা পানিতে এ মশা বংশবিস্তার করে। কেবল স্ত্রী এডিস মশাই মানুষকে কামড়ায়। প্রতি বছর এ মশার কামড়ে প্রায় চার লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।
এডিস মশা ডেঙ্গু, জিকা, চিকনগুনিয়া রোগ ছড়ায়। এগুলোর জন্য এখনো কোনো কার্যকরী টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ রোগ প্রতিরোধে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছেন। কোনো প্রতিষেধক না থাকায় এ মশার কামড় থেকে মানুষকে বাঁচানোর দিকে নজর দিয়েছেন তারা।
আর এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া। মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাসে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে উলবাকিয়া পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছে।
মশার হ্যাচারি
উলবাকিয়া মশাগুলো আলো পছন্দ করে না। হ্যাচারিতে এগুলো লালনপালনের দায়িত্বে রয়েছেন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর স্বেচ্ছাসেবকেরা। কলম্বিয়ার মেডেলিনে ওয়ার্ল্ড মস্কুইটো প্রোগ্রাম (ডব্লিউএমপি)-এর বায়োফ্যাক্টরি থেকে এ মশাগুলোকে রেফ্রিজারেটরে করে হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপার এ হ্যাচারিতে আনা হয়েছে।
নৌকার ভেতরে পানির মধ্যে রাখা হয়েছে মশাগুলোকে। নৌকার ওপরে কটন ক্যান্ডি রাখা আছে যাতে মশাগুলো খেতে পারে। তবে স্ত্রী মশার প্রজননের জন্য মানুষের রক্ত প্রয়োজন। তাই মাঝেমধ্যে হ্যাচারির কর্মীরা মশার কন্টেইনারের ভেতরে নিজেদের হাত ঢুকিয়ে দেন। মশাগুলো হাত থেকে প্রাণভরে রক্ত খায় হুল ফুটিয়ে।
প্রায় ৬০ শতাংশ কীটপতঙ্গে প্রাকৃতিকভাবেই উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু এডিস মশার ভেতরে এ ব্যাকটেরিয়া নেই। প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ডব্লিউএমপি অন্য কীটপতঙ্গ থেকে উলবাকিয়া সংগ্রহ করে এডিস মশার ডিমে প্রবেশ করাচ্ছে।
উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ডেঙ্গু ছড়ানো প্রতিরোধ করে। মশার ভেতরে এ রোগ থাকলেও উলবাকিয়ার দরুন তখন এটি আর ডেঙ্গু ছড়াতে পারে না। প্রায় ১০ বছর আগে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম উলবাকিয়া মশা ছাড়া হয়েছিল। এরপর শীঘ্রই স্থানটিকে 'ডেঙ্গুমুক্ত' ঘোষণা করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় উলবাকিয়া মশা ছাড়ার পর ডেঙ্গু সংক্রমণ ৭৭ শতাংশ কমে গেছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর কর্মকর্তারা এটিকে 'নিরাপদ মশা' হিসেবে ডাকেন।
এ পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ হলো স্থানীয়ভাবে উলবাকিয়া মশার বংশবৃদ্ধি করানো। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর লজিস্টিকস ম্যানেজার স্টাভরোস ডিমোপলাস বলেন, এর জন্য দুটো পদ্ধতি রয়েছে।
যদি স্ত্রী এডিস মশার মধ্যে উলবাকিয়া থাকে এবং পুরুষ এডিস মশা এ ব্যাকটেরিয়া বহন না করে, তাহলে এ দুই মশার প্রজননে সৃষ্ট নতুন মশার মধ্যে উলবাকিয়া তৈরি হয় এবং নতুন প্রজন্মের এসব মশা এক মানুষ থেকে আরেকজনে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে না। আর উল্টোটা হলে, অর্থাৎ পুরুষ মশা উলবাকিয়াসমৃদ্ধ হলে এবং স্ত্রী মশার শরীরে উলবাকিয়া না থাকলে তাদের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না অথবা বাচ্চা হলেও সেগুলো বড় হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয় না।
যেসব অঞ্চলে মশার প্রজনন হার বেশি, সেখানে উলবাকিয়া মশার হার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে তা হতে কিছুটা সময় লাগে, প্রায় বছর তিনেকের মতো। তবে একবার হলে এ হার দীর্ঘসময় ধরে রাখা যায় বলে ব্যাখ্যা করেন ডিমোপলাস।
মশা ডেলিভারি
৩৮ বছর বয়সী হেক্তর এসপিনোসার ওপর দায়িত্ব পড়েছে উলবাকিয়া মশা ডেলিভারির। তার মোটরসাইকেলে করে মশা ডেরিভারি দেবেন তিনি, পিঠের ব্যাকপ্যাকে অনেকগুলো ক্যানিস্টারে মশাগুলোকে রাখা আছে।
একজন সুপারভাইজর ও ১০ জন মোটরসাইক্লিস্ট ছয় মাস ধরে উলবাকিয়া মশা হন্ডুরাসের বিভিন্ন স্থানে ছাড়বেন। সবমিলিয়ে তারা ৮০ লাখের বেশি মশা পরিবেশে উন্মুক্ত করবেন, অর্থাৎ প্রতিদিন তাদের হাত ধরে প্রায় ৪০ হাজার মশা প্রকৃতিতে মুক্তি পাবে।
তেগুসিগালপার উত্তরে অবস্থিত এল মাঞ্চেনে গত বছর ভয়াবহ ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল। এ অঞ্চলে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ বাস করে। উলবাকিয়া মশা এখানে ছাড়ার পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে এ এলাকার ডেঙ্গু সংক্রমণ ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কথা।
লাতিন আমেরিকার অন্য অনেক দেশের রাজধানীর মতো তেগুসিগালপার অনেক এলাকাতেও গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই। এসব এলাকায় মোটরসাইকেলে উলবাকিয়া ছাড়ার পাশাপাশি ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর কর্মীরা নতুন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
'কম্যুনিটি লিবারেশন' নামক এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা জানুয়ারি পর্যন্ত প্রত্যন্ত এসব অঞ্চলের অনেক বাসিন্দার বাড়িতে নৌকা বসাবেন যাতে এসব বাসিন্দারা ওই নৌকার ভেতরে নিজেরাই উলবাকিয়া মশা লালনপালন করে পরিবেশে ছাড়তে পারেন। কাজটা বলার চেয়ে করা কঠিন। আর এটি শুরু করার জন্য বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাজের পেছনেই ছয় মাস ব্যয় হয়।
বলা বাহুল্য, এ কাজে প্রথমে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। একে তো মশার উৎপাতে সবাই বীতশ্রদ্ধ, তার ওপর নতুন করে মশা জন্মিয়ে পরিবেশে ছাড়ার কথা প্রথমবার শুনে সবাই-ই ধন্দে পড়ে গিয়েছিল, ব্যাপারটা হজম করতে তাদের সময় লাগে। কিন্তু পরে তাদের বিষয়টি নিয়ে জানানো হয়, কীভাবে এ পদ্ধতি কাজ করে তা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শেষমেষ ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস স্থানীয়দের মাঝে এ প্রকল্পের সমর্থনে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে ৯৩ শতাংশ মানুষ বিষয়টির অনুমোদন দেয়।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এবং বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, তারা যে কার্যক্রম শুরু করেছেন, সেটা হন্ডুরাসের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার পাশপাশি লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন।
তেগুসিগালপার রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির মাঝখানে ১০টা মোটরসাইকেল এগিয়ে যাচ্ছে। চালকদের পিঠে লাল রংয়ের ব্যাকপ্যাক — সেগুলোর ভেতরে তুচ্ছ অথচ অবলীলায় প্রাণঘাতী মশাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।