ভ্যাম্পায়ার কোত্থেকে এসেছে? রক্তের ব্যাধির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এর জন্মকথা!
ব্রাম স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলার গল্পের আগে থেকেই ভ্যাম্পায়ারের ধারণা মানুষের মাঝে ছিল — হয়তো ড্রাকুলা প্রকাশিত হওয়ার আরও কয়েক শতক আগেই। কিন্তু ভ্যাম্পায়র কি আদতে কখনো ছিল?
ড্রাকুলা প্রকাশিত হওয়ার ৮০ বছর আগে, ১৮১৯ সালে অ্যাংলো-ইতালিয়ান চিকিৎসক জন পলিদোরি দ্য ভ্যাম্পায়ার নামক একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের রূপের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় স্টোকারের বর্ণনাকেই আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি।
কিন্তু কীভাবে এবং কোথায় ভ্যাম্পায়ারের ধারণাটির উদ্ভব ঘটল? দেখা যাচ্ছে, স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলার কেন্দ্রভূমি বলকান অঞ্চলেই ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনার ফোকলোরের প্রথম উৎপত্তি হয়েছিল।
স্টোকার কখনোই ট্রান্সিলভানিয়া বা পূর্ব ইউরোপের অন্য কোনো এলাকায় ভ্রমণ করেননি। (তার উপন্যাসের কাউন্টের জমিদারি ছিল বর্তমান রোমানিয়া-হাঙ্গেরিতে।)
ব্রাম স্টোকারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ডাবলিনে। তার বন্ধু ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড ও উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন। স্টোকার উদারমনা ছিলেন এবং আয়ারল্যান্ডের স্বাধীন শাসনে বিশ্বাস করতেন। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি থিয়েটারে কাজ নেন — লন্ডনের লাইসিয়াম থিয়েটারে বিজনেস ম্যানেজার হিসেবে চাকরি শুরু করেন।
হাঙ্গেরিয়ান বন্ধু ও লেখক আরমিন ভ্যামবেরির দরুন স্টোকার ভ্যাম্পায়ার ফোকলোরের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ড্রাকুলা লেখার সময় তিনি ভ্যামবেরির পরামর্শ নিয়েছিলেন। ড্রাকুলা চরিত্রটিতে ১৪৩১ সালের ট্রান্সিলভানিয়ার রক্তপিপাসু যুবরাজ ভ্লাদ দ্য ইমপেলারের কিছুটা ছায়া রয়েছে।
ভ্যাম্পায়ার মিথের মেডিকেল উৎস
আরও অনেক মিথের মতো ভ্যাম্পায়ারের মিথও কিছুটা বাস্তবতা থেকে তৈরি হয়েছে। পরফিরিয়া নামক রক্তের একটি ডিসঅর্ডারের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ার মিথ জড়িত। এক সময় পূর্ব ইউরোপের রাজ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যে এ ব্যাধিটি প্রবল হয়ে ওঠে।
জন্ম থেকেই হওয়া রক্তের এ ডিসঅর্ডারটির কারণে মানবদেহে হিমোগ্লোবিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হেমের উৎপাদন কম হয়। রক্তের লোহিতকণিকার হেম নামক এ প্রোটিনটি ফুসফুস থেকে শরীরের টিস্যুগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। খুব সম্ভাবনা রয়েছে যে, এ ডিসঅর্ডারটিই ভ্যাম্পায়ার মিথের উৎস। এমনকি পরফিরিয়াকে মাঝেমধ্যে 'ভ্যাম্পায়ার ডিজিজ' নামেও ডাকা হয়।
পরফিরিয়া আক্রান্ত রোগীর লক্ষণগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক:
সূর্যের আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা: রোগী সূর্যের আলোর প্রতি তীব্র সংবেদনশীল হয়ে ওঠেন। এতে অনেকসময় মুখের আকৃতি বদলে যায়, ত্বক কালো হয়ে ওঠে, চুল বৃদ্ধি পায়।
শ্বদন্ত: বিকৃত মুখাবয়বের পাশাপাশি এ রোগে বারবার আক্রান্ত হলে মাড়ি মূল অবস্থান থেকে সরে যায়। ফলে দাঁত প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যেগুলো দেখতে শ্বদন্তের মতো লাগে।
রক্তপান: পরফিরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাব কালচে লাল হয়। তাই ফোকলোরে মনে করা হয়েছিল: এ রোগীরা মানুষের রক্ত পান করতেন। আদতে এ রোগীদের দেহের লোহিত রক্তকণিকা কমে যাওয়ায় তা পূরণে অনেক চিকিৎসক তাদেরকে রক্ত পান করার পরামর্শ দিতেন। তবে সেক্ষেত্রে কেবল পশুর রক্তই খেতে বলা হতো।
এ রোগীরা সন্ধ্যার পর বাইরে বেরোতেন। হয়তো সেজন্য মানুষ মনে করত, তারা রক্তের সন্ধানে বেরিয়েছেন। তার সঙ্গে শ্বদন্তের বিষয়টি তো ছিলই।
রসুনে অপ্রবৃত্তি: রসুনে থাকা সালফার পরফিরিয়ার কারণ হতে পারে, এতে শরীরে তীব্র ব্যথা হয়। সেজন্যই রোগীরা রসুন পছন্দ করতেন না।
আয়নায় নেই প্রতিচ্ছবি: মিথোলজিতে ভ্যাম্পায়ার আয়নার দিকে তাকাতে পারে না, নিজের প্রতিচ্ছবিও আয়নায় দেখতে পায় না।
পরফিরিয়ার কারণে সৃষ্ট মুখবিকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপ হতো। শরীরে ঠিকমতো অক্সিজেন প্রবাহিত হতে না পারায় মুখের টিস্যুগুলো নষ্ট হয়ে যেত, ভেঙে যেত মুখের গঠন। সুতরাং, বোঝাই যায় কেন এ রোগীরা আয়না দু-চোখে দেখতে পেতেন না।
ক্রুসিফিক্সে ভয়: স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের (১৪৭৮–১৮৩৪) সময় প্রায় ৬০০ 'ভ্যাম্পায়ার'কে খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল বলে জানা যায়। অভিযুক্ত এসব ভ্যাম্পায়ারের কেউ কেউ পরফিরিয়ার নির্দোষ রোগী ছিলেন। তাই খ্রিস্টান বিশ্বাস ও প্রতীকগুলোকে ভয় করার জন্য বেশ ভালো কারণ ছিল তাদের।
পরফিরিয়া
বর্তমানে পরফিরিয়া নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান রয়েছে আমাদের মাঝে। তাই এ রোগে আক্রান্তদের ভয় না পেয়ে তাদের প্রতি আমরা সমানুভূতিশীল হতে পারি, তাদের যত্ন নিতে পারি।
পরফিরিয়ার এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেই। এর প্রতিকার মূলত সহায়তাকেন্দ্রিক: ব্যথা নিয়ন্ত্রণ, তরল এবং উপসর্গ বাড়াতে পারে এমন ঔষধ ও রাসায়নিক উপাদান এড়িয়ে চলা। তবে স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসায় কিছুটা সাফল্য পাওয়া গেছে।
স্টোকার কি পরফিরিয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে, অথবা ডিসঅর্ডারটির সঙ্গে ভ্যাম্পায়ার ফোকলোরের সংযোগের কথা জানতেন? ড্রাকুলা প্রকাশের অল্প কয়েক বছর আগে ১৯১১ সালে এইচ. গুন্থার প্রথমবারের মতো পরফিরিয়াকে তালিকাভুক্ত করেন। তবে তারও কয়েক বছর আগে চিকিৎসক, গবেষক এ লেখক জর্জ হার্লে পরফিরিয়া আক্রান্ত একজন রোগীর কথা বর্ণনা করেছিলেন।
লেখাটি মাইকেল হেফারনের অভ প্লেগস অ্যান্ড ভ্যাম্পায়ারস: বিলিভেবল মিথস অ্যান্ড আনবিলিভেবল ফ্যাক্টস ফ্রম মেডিকেল প্র্যাক্টিস বইয়ের একটি সম্পাদিত অংশ।