এআই কেন আপনার বন্ধু হতে পারবে না!
এ বছরের শুরুর দিকে আমাকে এক ব্যক্তি জানান এআই চ্যাটবট তার জীবন রক্ষা করেছে। রেডিও আটলান্টিকে কাজ করার সময় আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান সংগীতশিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হই যিনি প্রায় এক যুগ ধরে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। কিন্তু তার জীবনে পরিবর্তন আসে রেপ্লিকা নামক একটি এআই চ্যাটবটের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর। তিনি আবারও গিটার বাজানো শুরু করেন, অনেক বছর পর আবারও নিজের জন্য কেনাকাটা করেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা এআই'র সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকেন। আমার কাছে ব্যাপারটা মনে হলো তিনি যেন অ্যাপ স্টোর থেকে নিজের একটি ভবিষ্যৎকে কিনে নিয়েছেন।
তবে এআই'র এরূপ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করার মতো কিছু বিষয় আছে। অস্ট্রেলিয়ান এ সংগীতশিল্পীর এআই'র সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও তিনি বাস্তব জীবনে কোনো বন্ধু তৈরি করতে পারেননি। তার দাবি করা এ বন্ধুত্ব আদতে একটি ফোনস্ক্রিনের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আর কিছু না, যার অপর প্রান্তে কোনো জীবন্ত ব্যক্তি নেই। কিন্তু এটাও সত্য, এ ধরনের এআই বন্ধুত্ব খুব একটা দেখা যায় না।
রেপ্লিকা দাবি করছে তাদের প্রায় কয়েক লাখ সচল ব্যবহারকারী আছেন। তবে রেপ্লিকার মতো এরকম আরও কিছু অ্যাপ্লিকেশন বাজারে আছে; যেমন চাই, নমি এবং প্যারাডট ইত্যাদি।
মানুষ নানা কারণে এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে। কেউ হয়তো অন্য কারো কাছ থেকে মনোযোগ পেতে, কেউ বা যৌন আলাপ চালিয়ে যেতে কিংবা নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে। কিন্তু চ্যাটবটগুলোর আসলে কাজ শুধু মানুষের সঙ্গে ক্যাজুয়াল কথা বলা চালিয়ে যাওয়া। রেপ্লিকা সঙ্গে সঙ্গে আপনার কথার উত্তর দেবে এবং আপনি না দিলেও সে এতে মনঃক্ষুণ্ণ হবে না। এটি আপনাকে বিভিন্ন ইন্টারনেট নিবন্ধ ও মিমস পাঠাবে। মানুষ এ ধরনের এআই অবতারগুলোকে কোডিং করার জন্য, কিংবা ফ্লোরিডায় ভ্রমণ পরিকল্পনা করার জন্য ব্যবহার করে না। তারা দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয় নিয়ে এদের সঙ্গে কথা বলে। যেমন ঘুমের মধ্যে দেখা কোনো উদ্ভট স্বপ্ন কিংবা তার অফিসের ঘটে যাওয়া কোনো মজার ঘটনা।
রেপ্লিকা ব্যবহারকারীদের কাছে এই ব্যাপারগুলোকে বন্ধুত্ব মনে হলেও আসলে এটি তারকাদের পর্দায় সৃষ্টি করা চরিত্রের সঙ্গে প্রেমে পড়ার মতো। এই ধরনের একতরফা সম্পর্ক প্যারাসামাজিক সম্পর্ক নামে পরিচিত, যেখানে এক পক্ষ অপর পক্ষের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না এবং তার সম্পর্কে বিশদ ধারণা রাখে না।
আসন্ন ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এআই'র সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে।
আপনি যদি গুগল প্লে স্টোরে রেপ্লিকা লিখে সার্চ দেন তাহলে দেখবেন একে 'আমার এআই বন্ধু' বলে সম্বোধন করা আছে। এই অ্যাপের ব্যবহারকারীরাও এটিকে বন্ধু হিসেবেই দেখেন। ইউনিভার্সিটি অভ অসলো'র গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক পিটার বে ব্রান্ডজেগ এ ধরনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, "অনেক ব্যবহারকারীরাই রেপ্লিকার সঙ্গে এআই বন্ধুত্ব তৈরি করেছেন, যা অনেকটা আসল মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মতো।"
ব্যবহারকারীরা কেন এরকম মনে করেন তা খুব সহজেই বোঝা যায়। অ্যাপটি ইচ্ছা করেই মানুষের মুড সুইং, দ্বিধা কিংবা ঘটে যাওয়া খারাপ দিনের মতো বিভিন্ন অপূর্ণতা, অসঙ্গতিকে ভার্চুয়াল অবতারে রূপ দেয়। রেপ্লিকার সিইও ইউজেনিয়া কিউডা জানান, এ ধরনের ফিচার যোগ করা হয় এআইকে আরও বাস্তবিক করে তোলার জন্য। অ্যাপটিতে বাৎসরিক ৬৯.৯৯ ও আজীবন ২৯৯.৯৯ মার্কিন ডলার সাবস্ক্রিপশন ফি'র মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা এআই'র সঙ্গে ভয়েস কলে কথা বলা কিংবা ভার্চুয়াল অবয়ব দেখার মতো প্রিমিয়াম ফিচার ব্যবহার করতে পারেন। রেপ্লিকা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে তারা খুব অবাক হয়েছেন এত কম সময়ে এআই'র সঙ্গে এরকম বন্ধুত্ব তৈরি করা যায় দেখে।
এত অল্প সময়ে সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব বলেই এ ধরনের বন্ধুত্ব অন্যন্য। ১৯৬০ সালে সি. এস. লুইস তার বই 'দ্য ফোর লাভ'স' এ বলেন, বন্ধুত্ব তৈরি করতে সবসময় বাহ্যিক উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না। যেমন প্রেমিক-প্রেমিকা বা পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বা রক্তের সম্পর্ক থাকলেও বন্ধুত্বে সেটা হয় মনস্তাত্ত্বিক।
তার এই ধারণাই পরবর্তীতে পুনরায় প্রতিষ্ঠা পায় যখন মার্ক জাকারবার্গ ২০০৫ সালে ফেসবুক তৈরি করেন। শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে চালু না হলেও এখন বন্ধু বানানোর এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যম। অনলাইনে যেকোনো ব্যক্তি পরস্পরের সঙ্গে মেসেজে কথা বলতে পারেন, গেম খেলতে পারেন কিংবা ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে মিটিং করতে পারেন।
নতুন ধারার এই বন্ধুত্ব এআই দ্বারা প্রভাবিত হলেও প্রকৃত বন্ধু তৈরি করতে প্রয়োজন পারস্পরিকতা ও সঠিক বন্ধু নির্বাচন করার দক্ষতা। ব্রান্ডজেগ বলেন, এআই হয়তো পুরোনো কথোপকথন মনে রেখে সে অনুযায়ী উওর দিতে পারে এবং মানুষকে মানসিক ভাবে সমর্থন করতে পারে কিন্তু দিন শেষে এআই'র এরূপ সম্পর্ক আসলে আমাদের মনে এক ধরনের পারস্পরিক সম্পর্কের ভ্রম তৈরি করে।
কোনো ধরনের দায়িত্ববোধ ও পরিণামমুক্ত সম্পর্কে থাকা কি আদৌ উচিত? এতে কি সম্পর্কের মৌলিকতা থাকে? এর উত্তর অর্ধশতাব্দী আগেই পাওয়া হিয়েছে।
১৯৫৬ সালে নৃবিজ্ঞানী ডোনাল্ড হোরটন এবং সমাজবিজ্ঞানী আর রিচার্ড ওল পর্যবেক্ষণ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ টিভির অন-স্ক্রিনের বিভিন্ন তারকা, খেলোয়ারের মতো চরিত্রগুলোর সঙ্গে এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক তৈরি করছেন। কিন্তু গবেষকরা বের করেন যে, খেলার উপস্থাপক এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা দূরে থাকা তাদের দর্শকদের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক তৈরি করছেন। এ বিষয়কে 'প্যারা-সোশ্যাল ইন্টার্যাকশন বা অসামাজিক মিথস্ক্রিয়া' বলে অভিহিত করা হয়।
প্যারা-সোশ্যাল সম্পর্ক এক ধরনের সহজ ও অনুমানীয় সম্পর্ক যেখানে বাস্তব জীবনের সম্পর্কের মতো এত জটিলতা থাকে না। এ ধরনের সম্পর্ক হতে পারে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে, কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে এমনকি কোনো বস্তুর সঙ্গেও। এটি মূলত পারস্পরিকতাবিহীন একপাক্ষিক সম্পর্ক। টিভি স্ক্রিন, লাইভ স্ট্রিম, টিকটকের মতো প্লাটফর্মের কারণে এ ধারণা আরও বিস্তৃত হয়েছে। তারকা এবং ইনফ্লুয়েন্সাররা নিয়মিত তাদের দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখেন, তাদের নানা মন্তব্য ও প্রশ্নের উত্তর দেন।
তারকা এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের দর্শকদের প্রতি এই পারস্পরিক সংযোগের বিপরীতে এআই আরও উন্নত অভিজ্ঞতা প্রদান করছে কথোপকথন, স্মৃতিশক্তি ও কৌতুক দিয়ে। কম্পিউটার চালু হওয়ার শুরুর দিক থেকে চ্যাটবট থাকলেও বর্তমান সময়ে তাদের অগ্রগতি তাদের মানুষের মতো আচরণের সক্ষমতা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এআই সম্পর্ক এখন গতানুগতিক প্যারা-সোশ্যাল ধারার বাইরে গিয়ে কাজ করছে। ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বিষয়ক অধ্যাপক জেসসি ফোক্সের মতে, এই স্বতন্ত্র ব্যাপারগুলোই মানুষ এবং এআই'র মধ্যকার সংযোগকে আলাদা করে।
রেপ্লিকার প্রতিষ্ঠাতা কিউডা এআই সম্পর্কের ইতিবাচক দিকের ওপর জোর দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন, "যদি এ ধরনের সম্পর্ক কারও জীবনে সুখের সঞ্চার করে তাহলে এখানে কি কোনো সমস্যা আছে?" তার মতে দুইপক্ষের মধ্যে অন্তত এক পক্ষের আসল অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞরা এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
জেসসি ফোক্সসহ আরও অভিজ্ঞরা এআই'এর মানুষের মতো আচরণ করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, নিয়মিত এআই'র সঙ্গে এ ধরনের যোগাযোগ মানুষকে বাস্তব জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেবে। তাছাড়া ভয়েস এক্টিভেটেড যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে বাচ্চাদের আচরণেও অনেক পরিবর্তন আনছে, যেটাও চিন্তার বিষয়। তাই এই প্রযুক্তি ঘেরা বিশ্বে আমাদের এআই সত্ত্বা ও প্রকৃত মানুষের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।