এআই এখন প্রায় নির্ভুলভাবে মৃত্যুর তারিখও ভবিষ্যদ্বাণী করবে!
মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পূর্বাভাস দিবে এমন একটি শক্তিশালী মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম নিয়ে কাজ করছেন ডেনমার্কের গবেষকরা। নতুন এই প্রযুক্তি জানিয়ে দিতে পারে আপনার সম্ভাব্য মৃত্যু সময়/ক্ষণ!
গবেষণাটি ন্যাচার কম্পিউট্যাশনাল সায়েন্সের একটি জার্নাল থেকে প্রকাশিত। 'লাইফটুভেক' (life2vec) নামের এই মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম মডেলটি একজন মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দিক ও ফলাফল সম্পর্কে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম।
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডেনমার্কের অধ্যাপক সুনে লেহম্যান বলেন, 'আমরা যেকোনো ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম।' যদিও গবেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে মডেলটি এখনো রিসার্চ প্রটোটাইপ হিসেবে আছে, বাস্তব জীবনে এখনও প্রয়োগ করা হয়নি।
লেহম্যান এবং তার সহ গবেষকরা ডেনমার্কের জাতীয় রেজিস্ট্রার থেকে ৬০ লাখ মানুষের বৈচিত্র্যময় একটি বিবরণ সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মানুষের জীবনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয় এবং পেশার মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই তথ্যাবলীর ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা একটি ভাষা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন যেটি লাইফটুভেকের জন্য একটি শব্দভাণ্ডার তৈরি করে— মানবজীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ করতে। অর্থাৎ, এই শব্দভাণ্ডার দিয়ে এআই প্রোগ্রামটি ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলোকে ভাষায় রূপ দিতে পারে। যেমন, 'সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে, ফ্রান্সিসকো নামের এক ব্যক্তি এলসিনোরের একটি দুর্গে একজন প্রহরী হিসাবে বিশ হাজার ডেনিশ ক্রোনার পেয়েছিলেন' বা 'মাধ্যমিক বোর্ডিং স্কুলের তৃতীয় বর্ষে, হারমায়োনি নামের শিক্ষার্থী পাঁচটি ঐচ্ছিক ক্লাস করেছিল।'
সহজ কথায়, তারা মানুষের অভিজ্ঞতা এবং জীবনের কার্যকলাপ সম্পর্কে বুঝে এবং তা নিয়ে কথা বলতে পারে এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেছেন।
লেহম্যান জানান, এসব তথ্য থেকে অ্যালগরিদমটি মানুষ কীভাবে ভাবে, অনুভব ও আচরণ করে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করতে পারে কিনা– তাও জানাতে সক্ষম হয় এটি।
একজন মানুষ কত তাড়াতাড়ি মৃত্যুবরণ করতে পারেন তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে ১ জানুয়ারি ২০০৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত– ৩৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। নির্দিষ্ট এই বয়সসীমা বেঁছে নেওয়ার কারণ এই বয়সসীমার মানুষের মৃত্যুর পূর্বাভাস দেওয়া অন্যান্য বয়সের তুলনায় বেশ কঠিন।
লাইফটুভেক ২০১৬ সালের পর চার বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনার অনুমান নির্ণয় করতে তথ্যগুলো ব্যবহার করেছে।
লাইফটুভেক কতটা ভালো করে পরীক্ষাতে তা বোঝাতে লেহম্যান বলেন '(তথ্যভাণ্ডার থেকে) আমরা এক লাখ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল বেঁছে নিয়েছিলাম, যাদের মধ্যে অর্ধেক বেঁচে ছিল এবং অর্ধেক মারা গিয়েছিল।' গবেষকরা ইতোমধ্যেই জানতেন ২০১৬ এর পরে কারা মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু অ্যালগরিদম তা জানতো না। তারপর পরীক্ষার পর দেখা যায়, অ্যালগরিদম ৭৮ শতাংশ সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।
রিপোর্ট অনুসারে, লাইফটুভেক মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নত মডেলের চেয়ে ১১ শতাংশ ভালো ফলাফল দেয়।
গবেষকরা আবিষ্কার করেন, হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা দক্ষ পুরুষ কর্মীদের ২০১৬ সালের পর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। অন্যদিকে, একজন পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া বা উচ্চ আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকা ব্যক্তির ছিল বেঁচে থাকার উচ্চ সম্ভাবনা।
তবে, গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। রিপোর্টে বলা আছে, তথ্যগুলোকে এলোমেলোভাবে পরীক্ষা করা হয়নি এবং তদন্তকারীরা পরীক্ষা এবং ফলাফল মূল্যায়ন উভয় সম্পর্কে বিশদ জানতেন। গবেষণায় শুধুমাত্র আট বছরের সময়কাল পরীক্ষা করা হয়েছে এবং জাতীয় রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ডেনমার্কের প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও নমুনায় সামাজিক জনসংখ্যাগত পক্ষপাত থাকতে পারে। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, যারা কোনো ধরনের বেতন পান না কিংবা কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাও নেন না, এমন ব্যক্তিদের তথ্য তাদের কাছে নেই।
তারা আরও জানান, গবেষণাটি একটি শক্তিশালী অবকাঠামো এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ দেশে হয়েছে। তবে অর্থনীতি ও সামাজিক পার্থক্যের কারণে লাইফটুভেকের ফলাফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য দেশের সাথে সাধারণীকরণ করা যায় কিনা তা নিয়ে এখনও অনিশ্চিত।
লেহম্যান স্বীকার করেছেন যে, অ্যালগরিদমটি 'অদ্ভুত এবং পাগলামো' বলে মনে হতে পারে, তবে এটির ওপর অনেক কাজ করা হয়েছে এবং বিমা কোম্পানিগুলোর অনেক সুবিধা হয়েছে। এই ধরনের অ্যালগরিদমের ব্যবহার বিমা শিল্পে বিমা নীতি, মূল্য নির্ধারণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের মেডিকেল এথিক্স বিভাগের প্রধান ডঃ আর্থার ক্যাপলানের মতে, লাইফটুভেকের মতো মডেল আরও বাণিজ্যিক পর্যায়ে বাজারে এলে বিমা কোম্পানিগুলি ভোক্তাদের আগে লাইফটুভেকের মতো মডেলগুলি ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী হবে। কারণ তারা তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যে সম্ভবত ঝুঁকি মূল্যায়ন বা কভারেজ এবং মূল্য নির্ধারণের সাথে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলগুলোকে ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, 'এটি বিমা বিক্রিকে আরও কঠিন করে তুলবে, আপনি ঝুঁকির বিরুদ্ধে বিমা চালাতে পারবেন না যদি সবাই জানে যে ঝুঁকিগুলি ঠিক কী।'
তবে ক্যাপলান, যিনি নতুন গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না, উল্লেখ করেছেন যে, লাইফটুভেক কোনো ব্যক্তি কোন বয়সে বা কীভাবে মারা যাবেন তা ভবিষ্যদ্বাণী করে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি অ্যালগরিদম ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না যে, একজন ব্যক্তি গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হবে কিনা। তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া মডেলগুলো আরও বেশি উন্নতি সাধন করবে। তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে আরও ভালো তথ্যভাণ্ডার থাকবে– যা আপনার জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে কী করতে হবে তার পরামর্শ দেবে।'
ক্যাপলানের ভাষ্যমতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আমাদের জীবনের আগাম পুর্বাভাস পেয়ে যাওয়ায় তা আমাদের জীবনকে আরও আকর্ষনীয় ও রহস্যময় করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা উদ্বিগ্ন যে রোবটেরা পৃথিবী দখল করবে এবং মানুষকে আর দরকার নেই এমন সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু, আমাদের যে বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার– তা হলো রোবটগুলো তথ্য হেরফের করে আমাদের আচরণ সম্পর্কে অনেক কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়ে পড়বে এবং আমাদের জীবনযাপন এতটাই অনুমানযোগ্য হয়ে যাবে যে তাতে জীবনযাপনের মূল্যবোধই হ্রাস পাবে।'