ইউক্রেনের রাশিয়ান কিনজাল মিসাইল ধ্বংস করার দাবিটি ভুয়া!
রাশিয়ান বিমান বাহিনীর মিগ-৩১কে যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা কেএইচ-৪৭এম২ কিনজাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ভূপাতিত করার দাবি করছে ইউক্রেন।
ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মাইকোলা ওলেশুক দাবি করেন, গত ৪ মে, ২০২৩-এ প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স (এডি) সিস্টেম ব্যবহার করে তারা একটি কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করেন।
এছাড়া ১৬ মে, ২০২৩-এ রাশিয়ান মিগ-৩১কে যুদ্ধবিমান থেকে উৎক্ষেপণ করা আরও ছয়টি কিনজাল মিসাইল ধ্বংস করার দাবিও করা হয় ইউক্রেন থেকে। তবে ইউক্রেনীয় মুখপাত্র জানান, কিনজাল মিসাইলের আঘাতে তাদের একটি প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের ব্যাটারিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউক্রেনের এই দাবিগুলো নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা হচ্ছে। অনেকে মজার ছলে বলছেন, যখনই ইউক্রেন দাবি করে তারা কোনো কিনজাল মিসাইল প্রতিহত করেছে, এটি আসলে তাদের ভূপৃষ্ট নিজের ওপর আঘাত নিয়ে প্রতিহত করেছে! অর্থাৎ, লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল আঘাত হানার পর মিথ্যে প্রতিহতের দাবি করছে ইউক্রেন।
বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে রাশিয়ান এই হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্রকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এই মিসাইল মোকাবেলা করা কেন এত কঠিন এর বৈজ্ঞানিক কারণসমূহ জানা যাক।
কিনজাল মিসাইল নিক্ষেপ পদ্ধতি
আগে শুধু হামলার প্রয়োজনে কিনজাল ক্ষেপনাস্ত্রসহ রাশিয়ান মিগ-৩১কে উড্ডয়ন করলেও– এখন নিয়মিত ইউক্রেনের আকাশে মিগগুলো টহলরত অবস্থায় থাকছে। রুশ গণমাধ্যম ইজভেস্টিয়া জানিয়েছে, দুই ডজনেরও বেশি মিগ-৩১কে রাশিয়ার বিমান বহরে যুক্ত হয়েছে।
এছাড়া, আগে কিনজাল হামলার জন্য রাশিয়ান মিগ আকাশে উড্ডয়ন করলে ইউক্রেন এক ধরনের সংকেত পেত সতর্ক হওয়ার, কিন্তু এখন সবসময় রাশিয়ান মিগগুলো আকাশে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত থাকায়– তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ঠিক কখন তাদের ওপর হামলা হবে।
টহলরত মিগ-৩১কে কে গাইড করার জন্য একটি নিরাপদ ডেটা লিংকের মাধ্যমে কো-অর্ডিনেটস (শত্রুর অবস্থান) ও রাডার চিত্র পাঠানো হয়। এ তথ্যসমূহকে রাডার ইমেজিং স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি অথবা একটি গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিমানে পাঠানো করা হয়।
মিগ-৩১কে এর উইপন্স ম্যানেজমেন্ট ও টার্গেটিং সিস্টেমে ডাটা দিয়ে কিনজালের অটোপাইলটকে প্রোগ্রাম করা হয়। মিসাইল সিকারে লক্ষ্যবস্তুর রাডার চিত্র স্থাপন করা হয়। তারপর বিমান চালক স্বয়ংক্রিয় লঞ্চ সিক্যুয়েন্স বা ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ প্রক্রিয়া চালু করেন।
কিনজাল মিসাইলটি মূলত ইসকান্দার-এম টাইপের মিসাইল– তবে এতে ইসকান্দার-এম মোটরের ছোট সংস্করণটি ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য একে মিগ-৩১কে এর সাহায্যে উৎক্ষেপণ করা হয় মোটরের বাকি শক্তিকে পূরণ করতে।
একটি কিনজাল উৎক্ষেপণের জন্য মিগ-৩১কে অবশ্যই ইস্কান্দার-এম-এর মতো একই গতি, উচ্চতা এবং কো-অর্ডিনেটসে (স্থানাঙ্ক) থাকতে হবে। এর রকেট বার্ন টাইমও হতে হবে ইস্কান্দারের মতো।
মিসাইলটি উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে, বিমানের পাইলট লঞ্চ সিক্যুয়েন্স চালু করেন। তারপর বিমানটি মিসাইল নিক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছালে, পাইলট মিসাইলটি নিক্ষেপ করেন।
সাধারণত, ২০ কিলোমিটার উচ্চতা ও ম্যাক ২ গতিতে মিসাইলটি নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষেপের পর মিসাইলের রকেট মোটরটি জ্বলে ওঠে। মিসাইলের অটোপাইলট, অ্যারোডাইনামিক ফিন ব্যবহার করে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। বাতাসের সাথে ঘর্ষণ বা ড্র্যাগ হ্রাস করতে মিসাইলটি দ্রুত স্ট্রাটোস্ফিয়ার সীমানায় উঠে যায়। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর যখন অ্যারোডাইনামিক ফিনটি অকার্যকর হয়ে যায়– তখন মিসাইলের থ্রাস্ট ভেলোসিটি কন্ট্রোল চালু হয়। স্ট্রাটোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছানোর পর ক্ষেপণাস্ত্রটি অনুভূমিকভাবে উড়ে যায় এবং এর গতি ম্যাক-১০ এ পৌঁছায়।
লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে মিসাইলটি থ্রাস্ট ভেক্টর এবং অ্যারোডাইনামিক ফিন উভয়কেই প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে। এরপর লক্ষ্যবস্তুর এলাকায় পৌঁছানোর পর মিসাইলটি তার একটিভ রাডার চালু করে। পূর্বে সংরক্ষিত টার্গেট ইমেজের সাথে নতুন রাডার ইমেজের ক্রমাগত তুলনা করা হয়। যখন এটি মিল খুঁজে পায়, তখন টার্গেটের প্রায় ১০ মিটার সীমানায় এসে মিসাইলটি কার্যকর হয়।
এয়ার ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ
একটি সফল মিসাইল প্রতিহতের (ইন্টারসেপশন) জন্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে (এডি) আকাশপথে শত্রু মিসাইল (টার্গেট মিসাইল) ও তা ধ্বংসকারী মিসাইল (ইন্টারসেপ্টর মিসাইল) মিলিত হওয়ার সঠিক বিন্দু বা ইন্টারসেপশন পয়েন্ট নির্ণয় করতে হবে।
আর এই ইন্টারসেপশন নির্ভর করে ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের গতি, টার্গেট মিসাইলের গতি এবং রাডারের রেঞ্জের মধ্যে টার্গেট শনাক্তের ক্ষমতার ওপর।
কিন্তু কিনজাল মিসাইলের ক্ষেত্রে যদি রাডার দেরিতে একে শনাক্ত করে, তাহলে মিসাইলের অতিরিক্ত গতির কারণে এর ইন্টারসেপ্টর পয়েন্ট নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আর মিসাইলকে রাডার আরও আগে শনাক্ত করলেও মিসাইলের বার বার গতিপথ পরিবর্তন কারণে রাডারকেও বারংবার ইন্টারসেপ্টর পয়েন্ট গণনা করতে হয়। ইন্টারসেপ্টর বা প্রতিরোধকারী মিসাইল টার্গেট মিসাইলের কাছাকাছি চলে আসলে, ইন্টারসেপ্টরের গতি পরিবর্তনের (জড়তা) সহজাত প্রতিবন্ধকতার কারণে টার্গেটের গতিবিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করা এবং ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে একটি হাইপারসনিক কিনজাল মিসাইলকে আকাশপথে প্রতিরোধ বা ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।
তবে, একটি মিগ-৩১কে উৎক্ষেপণের পরই একটি কিনজালকে আটকানোর সুযোগ আছে, যখন এটি স্ট্রাটোস্ফিয়ারে আরোহণ করা শুরু করেছে। এর জন্য প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে কিনজাল লঞ্চ পয়েন্টের খুব কাছে স্থাপন করতে হবে। কিন্তু একটি প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স মিসাইলের রেঞ্জ বা পাল্লা ৩০ কি.মি আর কিনজাল মিসাইলের রেঞ্জ দুই হাজার কিলোমিটার। তাই কোনোভাবেই প্যাট্রিয়টের পক্ষে কিনজালকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন কিনজাল মিসাইল ধ্বংস করার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি।