রাশিয়ার ৫০০ ডলারের ড্রোনের বিরুদ্ধে অসহায় কোটি ডলারের আব্রামস ট্যাংক
ইউক্রেনে রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগের কয়েক জায়গায় রিজার্ভ সেনাদের ব্যবহার করে পাল্টা-আক্রমণ চালিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। শুধু রোবোতিনে ছাড়া অন্যান্য জায়গায় রুশ সেনাদের অগ্রগতি ঠেকাতে ইউক্রেনের এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে ইভানিস্কা, বিলোহরিভকা, বার্দিচেভ, পবজেদা ও নভোমিখাইলভকাসহ বেশকিছু গ্রাম হয় এরমধ্যেই দখলে নিয়েছে, নাহলে শিগগিরই দখল নিবে রুশ বাহিনী।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে রুশ সেনারা আমেরিকার তৈরি তিনটি আব্রামস ট্যাংক ধবংস করেছে। এরমধ্যে সাম্প্রতিকতম ট্যাংকটি ধবংস করেছে গত ৪ মার্চ, খুব সম্ভবত করনেট অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল দিয়ে। তাঁর আগে দুটি আব্রামস ট্যাংক ধবংস করে খুবই সস্তা দামের রুশ ড্রোন। এসব ড্রোন থেকে রকেট প্রপেলড গ্রেনেড বা আরপিজির বিস্ফোরক ওয়ারহেড ফেলা হয় ট্যাংকের ওপর।
সস্তা এই ড্রোনগুলোকে রুশ সেনারা বলে ঘুল (বা প্রেত), ব্যাটারিচালিত এসব কোয়াডকপ্টার ফার্স্ট পারসন ভিউ বা এফপিভি ড্রোন শ্রেণিভুক্ত।
রাশিয়ার ঘুল ড্রোনগুলো একইসঙ্গে ওড়া অন্যান্য ড্রোনের সাথে তথ্য আদানপ্রদান করতে পারে, এতে তাঁদের কার্যপরিধি বা অপারেশনাল রেঞ্জ অনেকটাই বেড়ে যায়। যা খুবই কার্যকর পাহাড়ি বা উঁচুনিচু ভূমির এলাকায়, যেখানে ড্রোন পরিচালনায় সরাসরি বেতার তরঙ্গ পাঠানো বিঘ্নিত হয়। সেখানে অপারেটর অন্য ড্রোনের মাধ্যমে দূরবর্তী ড্রোনকে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে গাইডেন্স বা দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, বা সেটি পরিচালনা করতে পারেন।
রাশিয়ানদের দাবি, ঘুল ড্রোন এক ধরনের বিশেষ বেতার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দ্বারা পরিচালিত হয়, যা জ্যাম করা খুবই কঠিন। এই ড্রোনের দাম মাত্র ৫০০ ডলার, রাশিয়ার সেভেরদেলাভস্কে এটি উৎপাদন করা হচ্ছে। প্লাস্টিক দিয়ে নির্মিত এই ড্রোনের কিছু অংশ থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরি। সে তুলনায়, একটি আব্রামস ট্যাংকের দাম ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি ডলারের উপরে।
আমেরিকার তৈরি ব্রাডলি ফাইটিং ভিহাইক্যাল এবং আব্রামস ট্যাংকের চেসিস দিয়ে তৈরি মাইন অপসারণকারী যান ধবংস করতেও এই ড্রোন ব্যবহার করেছে রাশিয়া। জানা যায়, ইউক্রেনে এপর্যন্ত ৫০টি ব্রাডলি সম্পূর্ণ ধবংস বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
র্যাসভেট নামের একজন রাশিয়ান কমান্ডার বলেছেন, আব্রামস ট্যাংকের দুটি দুর্বল স্থান রয়েছে। এর একটি হলো টারেটের পেছনে ইঞ্জিন কম্পার্টমেন্টের ওপরের জায়গা, আর দ্বিতীয়টি হলো ট্যাংকের হাল বা মূল অংশের সাথে টারেটের সংযোগস্থল।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারির আগপর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে আব্রামস ট্যাংক ব্যবহার করেনি ইউক্রেন। ওইদিনই প্রথম যুদ্ধ অংশ নিতে দেখা যায় প্রায় ৭০ টনের এই ট্যাংককে। কিন্তু, এরমাত্র তিনদিন পরেই একটু আব্রামস ট্যাংক ড্রোন হামলায় অকেজো হয়ে পড়ে। ড্রোনের মাধ্যমে ট্যাংকের ট্র্যাকে আরপিজি রাউন্ড ফেলে সেটিকে অচল করে দেয় রুশ সেনারা।
মার্কিন সেনারাও আব্রামস ট্যাংক ব্যবহার করে। তাই এ সাঁজোয়া যানের গোপনীয়তা রক্ষায় দরকার পদক্ষেপ নেয় পেন্টাগন, এবং ইউক্রেনে পাঠানোর আগে বিশেষত ট্যাংকের বর্ম বা আর্মারের মান অবনমন করা হয়।
সুরক্ষার সেই ঘাটতি পূরণে সেখানে বসানো হয় এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাকটিভ আর্মার (ইআরএ বা সংক্ষেপে 'এরা')। যদিও আব্রামস ট্যাংককে বাড়তি সুরক্ষা দিতে তৈরি করা ইআরএ বর্ম হলো ইব্যাড। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউরোপে মোতায়েন করা ট্যাংকে এই আর্মার সংযোজন করতে শুরু করে পেন্টাগন। এটি বেশ পুরোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা। তবে আব্রামসের ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম আর্মারের সাথে লাগানো হলে একটি মানানসই সুরক্ষাই দেয়। ইউক্রেনে পাঠানো ট্যাংকগুলোতে তা নেই।
দুই ধরনের বর্ম থাকার পরেও ইরাকে প্রায় ২৩টি আব্রামস ট্যাংক ধবংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরাক যুদ্ধের আগে পেন্টাগন মনে করেছিল, এ ধরনের কম্পোজিট আর্মার সিস্টেম আব্রামস ট্যাংক রক্ষার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, ইরাকেও রাশিয়ান করনেট অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল ও আরপিজির আঘাতে আব্রামস ধবংস হয়।
এই অবস্থায় নতুন ধরনের ইআরএ আর্মারের অর্ডার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর। যা সরবরাহ করছে জেনারেল ডায়নামিক্স। এম-৩২ এআরএটি বা আরাট নামক নতুন বর্ম তৈরির জন্য জেনারেল ডায়নামিক্স ইসরায়েলের রাফায়েল কোম্পানির সাথে যৌথভাবে কাজ করেছে। কিন্তু, ইউক্রেনে পাঠানো ট্যাংকগুলোতে অত্যাধুনিক এই সুরক্ষাও নেই।
ট্যাংকে ইআরএ আর্মার সর্বপ্রথমে লাগায় ইসরায়েল। তবে এর ডিজাইন করেছিলেন ম্যানফ্রেড হেল্ড নামের একজন জার্মান। অচিরেই একই উপায় গ্রহণ করে রুশরা। প্রথমে তাঁরা কনট্যাক্ট- ১ নামের ইআরএ তৈরি করেছিল, আর তাঁদের সবশেষ উদ্ভাবন হচ্ছে রেলিকট। টি-৭২ ও টি-৯০ ট্যাংকের গায়ে বসানো যায় রেলিকট, ২০০৬ সাল থেকে রেলিকটের প্রচলন শুরুও হয়। টি-৭২ ট্যাংকের সর্বাধুনিক সংস্করণ টি-৭২বিথ্রিএম- এ রেলিকট সংযোজন করা হয়েছে। তবে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর ব্যবহৃত বেশিরভাগ ইআরএ বর্মই হলো আরো পুরোনো ধরনের।
ইআরএ বা এরা বর্মের বড় সমস্যা হলো এটি দিয়ে পুরো ট্যাংককে ঢেকে ফেলা সম্ভব হয় না। তা যদি সম্ভবও হয়, তবু শত্রুর গোলা যে ইআরএ টাইল ভেদ করবে না– তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। অন্যদিকে রকেট, কামানের গোলা, আরপিজির মতো বহু ধরনের উচ্চগতির হুমকি মোকাবিলা করতে হয় ট্যাংককে।
এজন্য জার্মান লেপার্ড-২ ট্যাংকে ইআরএ বর্ম রাখা হয়নি। তবে ইউক্রেন তাদের হাতে আসা লেপার্ড ট্যাংকে ধবংস হওয়া রুশ ট্যাংকের গা থেকে খুলে লাগিয়েছে কনট্যাক্ট-১ ইআরএ।
ড্রোন থেকে ফেলা বোমা ট্যাংকের ছাদে আঘাত হানার আগেই সেগুলোকে বিস্ফোরিত হতে বাধ্য করতে ট্যাংকের ওপর তথাকথিত "বার্ডকেজ" বা খাঁচাও লাগিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসরায়েলের অনেক মার্কাভা ট্যাংকেও এধরনের খাঁচা দেখা গেছে।
অস্ত্রের কথা অনেক হলো, এবার আসা যাক ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায়। রাশিয়ার পাল্টা-আক্রমণ ঠেকাতে যথাযথ পরিখা বা প্রতিরোধ সারি নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ইউক্রেন। এজন্যই তারা পাল্টা-আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ যথাযথ প্রতিরোধ কাঠামো থাকলে ক্ষয়ক্ষতি রুশ বাহিনীরই বেশি হতো। এনিয়ে এখন চলছে তুমুল সমালোচনা।
কারণ জানা যাচ্ছে, দৃঢ় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরির জন্য দরকারি অর্থ চুরি হয়েছে। ইউক্রেনে দুর্নীতি মারাত্মক এক ব্যাধি, যুদ্ধ ও বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের মধ্যেও যা দেদারসে চলছে।
এরমধ্যে যুদ্ধে ইউক্রেনের পরিস্থিতি যতোই দুর্বল হচ্ছে, ততোই বাড়ছে সেখান থেকে পশ্চিমাদের সরে আসার আলোচনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অত্যাধুনিক অস্ত্র-সজ্জিত নাৎসি সেনাবাহিনীকে কার্যকর অথচ সস্তা অস্ত্রের বিপুল ব্যবহারের মাধ্যমে পরাজিত করেছিল রুশ জনগণ। সেটি ছিল দেশমাতৃকা রক্ষার যুদ্ধ। ইউক্রেনে রাশিয়া কী সেই শিক্ষাকে আগ্রাসনের যুদ্ধে সফলভাবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে? আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার যুদ্ধকৌশল কিন্তু তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এজন্যই ব্যয়বহুল মার্কিন ট্যাংকগুলো ধ্বংসের ঘটনার প্রতীকী তাৎপর্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী।
অনুবাদ: নূর মাজিদ