নতুন করে জাহাজে হামলা: সোমালিয়ার উপকূলে আবারও সক্রিয় হচ্ছে জলদস্যুরা?
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে এমভি আবদুল্লাহ নামক একটি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালি জলদস্যুরা। এরপর জাহাজটি সোমালি উপকূলে নিয়ে যায় তারা।
বর্তমানে জাহাজটি সোমালি উপকূলের গারাকাড থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে নোঙর করা আছে। চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপের (কেএসআরএম) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন এ জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন।
আফ্রিকা মহাদেশের এ উপকূলে জলদস্যুরা আবার নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে তারা বেশ কয়েকটি জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
সর্বশেষ এক দশক আগে সোমালি উপকূলে দেশটির জলদস্যুরা বিস্তৃত পরিসরে তাদের অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত। মাঝখানে এ নৌপথটি ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, সোমালি জলদস্যুরা আবারও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারে মহাসমুদ্রে।
সাম্প্রতিক হামলা
সোমালি জলদস্যুদের সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী বাল্ক কার্গো ক্যারিয়ার এমভি আবদুল্লাহ। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নৌবাহিনী ইইউন্যাভফর আটলান্টা জানিয়েছে, সোমালি উপকূল থেকে নভেম্বরের শেষ নাগাদ হতে কমপক্ষে ১৪টি নৌযান ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার ট্রলার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এর দু সপ্তাহ পরে লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী একটি জাহাজও হামলার শিকার হয়। তবে দুটি নৌযানের নাবিকদেরই উদ্ধার করা হয়।
এরপর ডিসেম্বরে মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন নামক একটি জাহাজ ছিনতাই হয়। ১৭ নাবিকসহ জাহাজটি এখনো ছিনতাইকারীদের কবলে রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিপৎসংকুল সোমালি জলসীমা ও জলদস্যুদের শিকার যত জাহাজ!
এ বছরের জানুয়ারিতে বেশ কয়েকটি জাহাজে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি ঘটনায় ভারতীয় নৌবাহিনী জলদস্যুদের কাছ থেকে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধার করেছে।
কী কারণে নতুন এসব হামলা?
রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল বিবিসিকে বলেন, এ জলদস্যুরা সাগরে নিরাপত্তার ফাঁকফোকরের সদ্ব্যবহার করছে।
২০০৫ ও ২০১২ সালের মাঝমাঝি সমুদ্রে জলদস্যুবৃত্তি বেড়ে গেলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাহিনী এসব অঞ্চলে পাহারা দিতে শুরু করে। কিন্তু সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের জাহাজের ওপর আক্রমণের পর এসব বাহিনীকে ওই সাগরে স্থানান্তর করা হয়।
পূর্ব-আফ্রিকান উপকূলের দেশগুলোর আঞ্চলিক সংগঠন ইন্ডিয়ান ওশেন কমিশন (আইওসি)-ও একই মত প্রকাশ করেছে।
তবে জানুয়ারির শেষদিকে এক বিবৃতিতে জলদস্যুদের সক্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে আরও কিছু সম্ভাব্য কারণের কথা জানিয়েছে আইওসি।
প্রায় এক দশক আগে সোমালিয়ানদের মধ্যে সমুদ্রে দস্যুবৃত্তির পথকে বেছে নেওয়ার একটি বড় কারণ ছিল নিজেদের সমুদ্রে তাদের মাছ আহরণ করতে না পারা।
১৯৯১ সালে গৃহযুদ্ধের ফলে সোমালিয়ায় সর্বশেষ কার্যকর সরকারটিরও পতন ঘটে। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় উপকূলের মালিক সোমালিয়া। সরকারি বিধিনিষেধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় তিন হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রে বিদেশি নৌযানের লুটাপাটের বিপুল নজির রয়েছে।
আরও পড়ুন: সোমালিয়ার জেলেরা যেভাবে জলদস্যু হয়ে উঠল
টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি ট্রলারের হামলা থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯০-এর দশকে সোমালিয়ায় প্রথম জলদস্যুদলের বিস্তার ঘটে। এছাড়া দারিদ্র্য, অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাবের পাশাপাশি গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা, সহিংসতাও জলদস্যুতার মতো অপরাধের পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
আইওসি জানিয়েছে, সোমালিয়ার বর্তমান মৎস্য আহরণ নীতির ফলে দেশটির উপকূলে বিদেশি মাছধরার ট্রলারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উপকূলবর্তী সোমালিরা আবারও জলদস্যু হওয়ার পথ বেছে নিচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
এছাড়া সোমালিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল-শাবাব গ্রুপ জাহাজের ওপর হামলার মদত দেওয়ার অনুমানের কথাও উল্লেখ করেছে আইওসি। জলদস্যুদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তিপণের কিছু অর্থ এ জঙ্গিগোষ্ঠী পায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যা চায় জলদস্যুরা
২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মাঝে হর্ন অব আফ্রিকায় জলদস্যুরা নাবিক ও জাহাজ জিম্মি করে ৩৩৯ মিলিয়ন থেকে ৪১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের এক অনুমানে বলা হয়েছে।
নাইজেরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও পূর্ব আফ্রিকান উপকূলে জলদস্যুবৃত্তি বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল অয়েওল মনে করেন, এখনও জলদস্যুরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই এসব জাহাজ ছিনতাই করছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেছেন, এমভি আবদুল্লাহর দখল নেওয়া জলদস্যুরা এখনো কোনো মুক্তিপণ চায়নি বা এ ব্যাপারে কোনো যোগাযোগও করেনি।
আইওসি গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঘটা হামলাগুলোকে জলদস্যুতা হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব চেস্টারের শিক্ষক ও হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. জেস সিমন্ডস মনে করেন, জাহাজ ছিনতাইয়ের এসব ঘটনা প্রতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করা উচিত।
জাতিসংঘের জলদস্যুতা বিষয়ক সংজ্ঞার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, মহাসমুদ্রে, যেখানে কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেসব জায়গায় ঘটা ছিনতাই জলদস্যুতা হিসেবে বিবেচিত হয়। সাম্প্রতিক ঘটা বিভিন্ন ছিনতাইয়ের অনেকগুলো সোমালিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে ঘটেছে।