এক্সবি-৭০: কনকর্ডের চেয়েও দ্রুতগামী ছিল এ সুপারসনিক বিমান, তৈরি হয়েছিল মাত্র ২টি
কনকর্ডের প্রথম ফ্লাইট আকাশে ওড়ার পাঁচবছর আগেই আরেকটি সুপারসনিক বিমান ডানা মেলেছিল। পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি বিমানটির নাম ছিল এক্সবি-৭০ ভালকারি।
৬০ বছর আগে ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন বিমানবাহিনীর জন্য তৈরি করা এ বিমানটি প্রথম ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এক পর্যায়ে বিমানটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ দুই হাজার মাইল গতিতে উড়তে সক্ষম হয়েছিল। কনকর্ডের চেয়ে এ গতি ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর এয়ার ফোর্স ম্যাটেরিয়াল কমান্ড-এর ইতিহাসবিদ টনি ল্যান্ডিস বলেন, 'এক্সবি-৭০-এর সার্বিক নকশা ছিল সৌন্দর্যের প্রতীক। এমন বেগে আর উচ্চতায় উড়তে সক্ষম কোনো বিমান ৬৫ বছর আগে বানানো হয়েছিল, তা আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কম্পিউটারভিত্তিক প্রকৌশলবিদ্যার যুগে এসেও হজম করা বেশ কঠিন।'
অবশ্য এক্সবি-৭০ প্রোগ্রামও সমস্যামুক্ত ছিল না। সামরিক বিমান হিসেবে এটি আকাশে ওড়ার আগেই সেকেলে হয়ে যায়। এর স্বল্প আয়ুষ্কাল শেষ হয় এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে।
তবে নকশার কারণে সুপারসনিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে বিমানটি একটি আইকনে পরিণত হয়। 'আজকের দিনেও ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স-এ এলে দর্শণার্থীরা ভালকিরি দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন, এর আকার ও নকশার প্রশংসা করেন। অনেকেই জানতে চান, এটা নতুন কোনো ডিজাইন কি না, কারণ তারা এরকম কিছু আগে কখনো দেখেননি,' বলেন ল্যান্ডিস।
ওই সময়ের উড়োজাহাজ নির্মাণের অন্যতম বড় কোম্পানি নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন ও বোয়িংয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতা থেকে জন্ম হয় বিমানটির। ১৯৫৭ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী নর্থ আমেরিকান এভিয়েশনকে দায়িত্ব দেয়, ৬০ হাজার ফুট উঁচুতে মাক ২ গতিতে ছুটতে ও পারমাণবিক অস্ত্র পরিবহনে সক্ষম এমন একটি বোমারু বিমান নির্মাণ করতে।
১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর একটি মার্কিন ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করা হয়। এ ঘটনার পর প্রথাগত বোমারু বিমানের বদলে ব্যালিস্টিক মিসাইলের দিকে বেশি নজর দেয় আমেরিকা।
১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা দেন, এক্সবি-৭০-এর পক্ষে শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করার সম্ভাবনা খুব কম। ফলে নর্থ আমেরিকান যখন বিমানটি তৈরি করা শুরু করছিল, তখন পুরো প্রোগ্রামটির লক্ষ্য উচ্চ-গতি সম্পন্ন বিমান তৈরির দিকে পরিবর্তিত হয়।
১৯৬৪ সালের ১১ মে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম এক্সবি-৭০ ওরফে ভালকারিকে প্রকাশ্যে আনা হয়। প্রায় ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ডানা, ৬টি টার্বোজেট ইঞ্জিন ও ১৮৫ মিটার লম্বা এ বিমানটি এখন পর্যন্ত তৈরি সবচেয়ে সুদর্শন বিমানগুলোর একটি।
'১৯৬০-এর দশকজুড়ে সামরিক ও বেসামরিক উভয় খাতই সুপারসনিক বিমান বানাতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করেছে,' বলেন ল্যান্ডিস। 'প্রথমদিকে প্রায় সবগুলো কোম্পানিই তাদের বিমানের প্রাথমিক ডিজাইন করেছিল এক্সবি-৭০-কে অনুসরণ করে,' বলেন তিনি।
বোমারু বিমান হিসেবে ভালকিরি'র ভূমিকা বাতিল হওয়ার পর এটির বিকল্প ব্যবহার নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করতে থাকেন নকশাকারীরা। 'নর্থ আমেরিকান কোম্পানির প্রকৌশলীরা খুবই সৃজনশীলতার সঙ্গে বিমানটির সম্ভাব্য বিকল্প সব ব্যবহারের ধারণা দিতে থাকলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এটির সামরিক ও বেসামরিক পরিবহন সংস্করণটিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়,' বলেন ল্যান্ডিস।
বিমানটির ৩টি সংস্করণ প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে ছিল ১৫৮টি আসনের একটি ও লাউঞ্জসহ ১১৪ আসনের একটি 'ডিলাক্স' ডিজাইন।
'প্রথম এক্সবি-৭০-কে ক্যালিফোর্নিয়া ফিরিয়ে নেওয়া হয় পরিদর্শন ও আপগ্রেড করার জন্য। এ সুযোগে বিমানটিকে পরিবহন বিমান হিসেবে প্রচারণার জন্য নর্থ আমেরিকান বিমানের একটি পাশে নকল জানালা লাগায়। পরে অবশ্য আরও পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের আগে সেগুলো খুলে নেওয়া হয়,' বলেন ল্যান্ডিস।
এমন নকশার একটি বিমানে যাত্রীর অভিজ্ঞতা কেমন হতো তার ধারণা করা বেশ কঠিন। তবে ল্যান্ডিস মনে করেন, এক্সবি-৭০-এ চড়ার অনুভূতিও কনকর্ডের মতোই হতো: 'মসৃণ, আরামদায়ক, এবং দুই আসনের মাঝে বিস্তর ফাঁকা জায়গা।'
তার চেয়েও বড় কথা হলো, কনকর্ডের সাড়ে তিন ঘণ্টার বদলে এক্সবি-৭০ দিয়ে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে কেবল আড়াই ঘণ্টাই যাওয়া সম্ভব হতো।
বিমানটির অন্যান্য প্রস্তাবিত সংস্করণগুলোর মধ্যে ছিল এটিকে নভোযান এবং এমনকি মিনিটম্যান মিসাইলের উৎক্ষেপণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা। তবে পরিবহন সংস্করণটির মতো এগুলোও কখনো শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৬৬ সালে এক দুর্ঘটনার কারণে এক্সবি-৭০ প্রোগ্রামের আয়ু আরও কমে যায়। তখন পর্যন্ত কেবল দুটি বিমান তৈরি করা হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ছিল প্রথম এক্সবি-৭০-এর আরেকটু উন্নত সংস্করণ।
দ্বিতীয় বিমানটি নিয়ে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির আয়োজিত এক ফটোশ্যুটের সময় সেটি মাঝ আকাশে একটি এফ-১০৪এন বিমানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ে। এতে ছোট বিমানটির পাইলট ও এক্সবি-৭০'র দুই পাইলটের একজন নিহত হন। অন্য পাইলট মারাত্মক আহত হন।
বিধ্বস্ত ভালকিরি দিয়ে কেবল ৪৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছিল। টিকে থাকা প্রথম ভালকিরি ৮৩টি ফ্লাইটে মোট ১৬০ ঘণ্টার কিছু বেশি ওড়ার পর অবশেষে প্রোগ্রামটি বাতিল করা হয়।
১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ডানা মেলেছিল এক্সবি-৭০। ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসা'র একটি গবেষণাকেন্দ্র থেকে উড়িয়ে ওহাইওর রাইট-প্যাটারসন বিমানঘাঁটিতে এয়ার ফোর্স মিউজিয়ামে আনা হয় ভালকিরিকে।
হয়তো খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখেনি প্রোগ্রামটি, তবে এক্সবি-৭০ মার্কিন বিমানবাহিনীর ইতিহাসে একটি কিংবদন্তিতুল্য নাম। ল্যান্ডিস বলেন, 'এক্সবি-৭০-এর কাজ থেকে সুবিধা পেয়েছে সব ধরনের বৃহৎ, উচ্চগতির বিমান নকশাই। এ প্রোগ্রামের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন থেকে পাওয়া ডেটা এখনো বিমানের নকশা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।'