ভারতে জন্মহারের পতন জাপানের মতো পরিস্থিতি এড়ানোর চাপ তৈরি করছে
জন্মহার কমার সাথে সাথে অর্থনীতির বিকাশে নতুন জনশক্তির সংকটে রয়েছে এশিয়ার বড় দুই অর্থনীতি চীন ও জাপান। জনসংখ্যা বিন্যাসে পরিবর্তনের একই চাপ ধেয়ে আসছে ভারতের দিকে। ভারত বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হলেও– সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ভবিষ্যৎ এই পরিণতি এড়াতে তাই এখন থেকেই দেশটির নীতিনির্ধারকদের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত সপ্তাহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত জার্নাল– ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে এ গবেষণা প্রতিবেদন। উর্বরতা বা জন্মহার নিয়ে এটি বৈশ্বিক পর্যায়ের এক গবেষণা। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৫০ এর দশকে ভারতে নারী প্রতি সন্তান জন্মদানের গড় হার ছিল ৬.২, ২০২১ সালেই যা ২ এর নিচে নেমে এসেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ গড় জন্মহার হবে ১.২৯ এবং ২১০০ সালে তা ১.০৪ এ নামবে এমন প্রক্ষেপণই করা হয়েছে গবেষণায়।
২.১ শতাংশ শিশু জন্মহার থাকলে সেটি মৃত্যুর কারণে জনসংখ্যার যে ঘাটতি তৈরি হয় তা পূরণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে জনসংখ্যা স্থির থাকবে। কিন্তু, জন্মহার এর নিচে নামাই চরম বিপদের সংকেত। নতুন মুখের অভাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যা যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি বাড়বে বয়সের ভারে ন্যূজ জনগোষ্ঠী। জাপান যে সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে।
এই সমস্যা অবশ্য একা ভারতের নয়, বরং বৈশ্বিকভাবে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেমন ২০২১ সালে গড় বৈশ্বিক জন্মহার ছিল ২.২, যা ১৯৫০ এর দশকে ছিল ৪.৫। গবেষণার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, এই হার ২০৫০ সালে ১.৮ এবং ২১০০ সালে ১.৬ এ নামবে।
এদিকে ভারতের প্রত্যাশিত গড় আয়ু আরো বাড়ছে, এরমধ্যে জন্মহার কমে যাওয়ার ঘটনায় তরুণদের চেয়ে বেশি হবে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। জনমিতির এই নাটকীয় পরিবর্তনকে নতুন গতি দিচ্ছে জন্মহারের দ্রুত পতন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন নানান প্রতিকূলতা নিয়ে হাজির হবে। এতে বিপুল সংখ্যক জ্যেষ্ঠ নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। তরুণ কম থাকায়, বয়স্কদেরও কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে। সেজন্য তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে– যা মোটেও সহজ হবে না ভারতের মতো দেশে। এইক্ষেত্রে সম্পদ বৈষম্য এবং কন্যাশিশুর চেয়ে ছেলে শিশু নেওয়ার প্রতি ভারতীয়দের ঝোঁক পুরো বিষয়টিকে আরো জটিল রূপ দেবে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের এসব সমস্যার সমাধানে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান পুনাম মুত্তের্জা বলেন, "ভারতের জনসংখ্যার এই সমস্যা আরো কয়েক দশক পরের হলেও– ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখন থেকেই আমাদের সার্বিক উদ্যোগ নিতে হবে। জন্মহার পতনের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমন ও তার সাথে মানিয়ে চলতে– প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক নীতির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও পেনশন খাতের বড় সংস্কার করতে হবে।"
অবশ্য জন্মহার কমতে থাকলেও, জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ অনুসারে, ২০৫০ সালে দেশটির মোট জনসংখ্যা ১৬০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু, নবীনদের অনুপাত তুলনামূলকভাবে কম থাকলে– এত বড় জনসংখ্যার নিজস্ব বিভিন্ন সমস্যা নিয়েই হাজির হবে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে পেরেছেন, যাকে জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বলা হয়।
দেশটির মোট জনসংখ্যাকে এক অর্থে নবীন বলাই যায়, যেখানে গড় বয়সের মধ্যক ৩০ এরও নিচে। তবে তারুণ্যের এই বাহুল্য আগামীতেও ধরে রাখাটাই হচ্ছে এখনকার প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর সেটা করতে হবে তথাকথিত মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকা পড়ার আগেই। উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আগে অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়লে একটি দেশ মধ্য আয়ের স্তরেই আটকে পড়াকে বলা হয় মিডল ইনকাম ট্র্যাপ।
কিছু বিশেষজ্ঞের শঙ্কা, এরমধ্যেই সে ফাঁদ তৈরি হয়ে গেছে ভারতের জন্য। কারণ জন্মহারের সার্বিক অবস্থা কেবল ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকেই গভীর করবে। সাধারণত দরিদ্র পরিবারগুলোয় সন্তান থাকে বেশি, ধনী পরিবারে কম। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নানান দিক থেকেই বঞ্চনার শিকার।
সতর্ক করে অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক অরুন কুমার বলেন, "উচ্চ বেকারত্ব হারের সাথেসাথে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব আছে, যাদের ঘরে ধনীদের তুলনায় সন্তানের সংখ্যাও বেশি। এই বিষয়টি আগামীতে এক জনমিতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, যার ফলে তরুণ জনসংখ্যার অর্থনৈতিক সুফল পাবে না ভারত।"
আরো ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি জানান, ভারতের অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন রাজ্যগুলোয় জন্মহার সবচেয়ে কমবে, আর দরিদ্র্য রাজ্যগুলোতে তা বেশি থাকবে। "পুষ্টির অভাবে দরিদ্র পরিবারে শিশু মৃত্যুর হার বেশি; বাবা-মাদের শিক্ষাদীক্ষাও কম, পাশাপাশি এই শিশুরা ভালো স্বাস্থ্যসেবাও পায় না। একারণে দরিদ্র মা-বাবাও ভয়ে থাকে, তাঁরা গড়ে পাঁচটি করে সন্তান নেয়, যাতে অন্তত একটি সন্তান বেঁচে যায়। অন্যদিকে, ধনীরা তাঁদের শিশুর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ায়- কম সন্তানই নিতে চান।"
সামাজিক এই অবস্থা সম্পন্ন ও দরিদ্র এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে আরো প্রকট হবে। সৃষ্টি করবে লক্ষণীয় বৈষম্য। যা ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সকল খাতকে প্রভাবিত করবে। জনমিতির পরিবর্তন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।