এই জাদুঘরে এআই দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা যায়
মার্গারেট কেরি-বোকে (৯৪) নিউ অরলিন্সের ন্যাশনাল ডাব্লুডব্লিউআইআই ২ জাদুঘরের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বানানো জাদুঘর) একটি গ্যালারিতে হেঁটে যাওয়ার সময় অবাক হয়ে যান। তিনি নিজের একটি স্পষ্ট, প্রায় জীবন্ত ভিডিও দেখে অবাক হয়ে যান। তার কাছে মনে হচ্ছিল, তিনি নিজেকে আয়নায় দেখছেন।
ভিডিওতে কেরি-বোকে একটি আর্মচেয়ারে বসেছিলেন। তিনি গোলাপি ব্যালে-স্টাইলের চপ্পল পরে বসেছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হোম-ফ্রন্ট ইউএসও নৃত্যশিল্পী হিসেবে ফেলে আসা দিনের গল্প বলছিলেন।
কেরি-বোকে সেই প্রজন্মের লোক যাদের একসময় 'সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম' হিসেবে পরিচিতি ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার প্রজন্মের অনেকেই ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছেন।
জাদুঘরটি অনুমান করছে, প্রতিদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেঁচে যাওয়া ১৩১ জন প্রবীণ সৈনিক মারা যাচ্ছেন। তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরটি 'ভয়েস ফ্রম দ্য ফ্রন্ট' নামে একটি প্রদর্শনী চালু করেছে। তাদের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে জাদুঘরটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ভয়েস-রেকগনিশন প্রযুক্তি (কণ্ঠ শুনে চিনতে পারে এমন প্রযুক্তি) ব্যবহার করছে যেটি দর্শনার্থীদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের আমেরিকানদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটেরান্স অ্যাফেয়ার্স বিভাগের গত বছরের তথ্য অনুসারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ১৬.১ মিলিয়ন আমেরিকানদের মধ্যে মাত্র ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৫০ জন বেঁচে আছেন যা মোট অংশগ্রহণকারীর ১ শতাংশেরও কম। বিভাগটি ধারণা করছে, ২০৩৬ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া মাত্র কয়েকশ আমেরিকান জীবিত থাকবেন।
জাদুঘরের সহ-সভাপতি এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কর্নেল পিটার ক্রিয়েন বলেছেন, "আমরা সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করছি।" তিনি এই মাসে চালু হওয়া 'ভয়েস ফ্রম দ্য ফ্রন্ট' প্রদর্শনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রদর্শনীর অংশ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৮ জনের মধ্যে তিনজন পর্দায় নিজেকে দেখতে পাওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হার্শেল উড্রো 'উডি' উইলিয়ামস যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-যুগের শেষ জীবিত 'মেডেল অব অনার' পেয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন।
একজন সমর্থকের কাছ থেকে ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান পাওয়ার পর জাদুঘর প্রদর্শনীর জন্য ভলিউম্যাট্রিক ভিডিওর (যা একটি ব্যক্তি বা বস্তুর থ্রিডি ভিডিও ধারণ করে সেটির একটি জীবন্ত উপস্থাপনা তৈরি করে বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা প্রদান করে) ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিল৷ তারা প্রতিটি কোণ থেকে ভিডিও ধারণ করতে ১৩টি ক্যামেরা ব্যবহার করেছে।
যখন মার্গারেট কেরি-বোকে তার নর্থ ক্যারোলিনায় বাড়ি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের ফিল্ম স্টুডিওতে যান তখন 'স্টোরিফাইল' নামে একটি কোম্পানির চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাকে দুই দিনের সাক্ষাৎকারের জন্য দুটো অভিন্ন পোশাক আনতে বলেছিলেন। তিনি টিংকার বেলের (ডিজনির 'পিটার প্যান' অ্যানিমেশনের একটি বিখ্যাত চরিত্র) মতো দেখতে একটি বড় ব্রোচ পরেন যেটি তিনি যুদ্ধের পরে ডিজনির হয়ে পরেছেন এবং ছবি তুলেছিলেন। তিনি প্রতিদিন তার সোয়েটারে একই স্থানে সেটি পরতেন।
শুটিং চলাকালীন প্রযোজনা দল তার পা এবং হাত কোথায় ছিল তা চিহ্নিত করে রাখতো এবং প্রায় ১ হাজার প্রশ্নের জন্য (সাক্ষাৎকারে প্রশ্নগুলো তাকে করা হয়েছিল) পুরো সময় জুড়ে সেগুলো ট্র্যাক করেছিল। এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল কেরি-বোকে ভিডিওতে তার উত্তর শেষ করার পরে তার শুরুর ছবি একই অবস্থানে ফিরে আসবে— এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। থ্রিডি ভিডিওতে কেরি-বোকে দর্শনার্থীর দিকে মুখ করে এমন ভাবে বসে থাকেন যেন তিনি মনোযোগ দিয়ে তার প্রশ্ন শুনছেন এবং তারপর মাথা নাড়ছেন৷
প্রযুক্তির সম্ভাব্য উন্নতির সাথে সাথে সাক্ষাত্কারগুলোকে হলোগ্রাফে (দ্বিমাত্রিক তলে আঁকা ত্রিমাত্রিক ছবি যা বিভিন্ন কোণ থেকে দেখলে বিভিন্ন রকম দেখায়) রূপান্তরিত করা হতে পারে। এর ফলে জাদুঘরে প্রবেশকারী দর্শনার্থীরা দেখতে পারবেন, একজন থ্রিডি কেরি-বোকে একটি চেয়ারে বসে তাদের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন।
প্রদর্শনীতে দর্শকদের প্রশ্ন বুঝতে ভয়েস রেকোগনিশন এবং প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক উত্তর অনুসন্ধান করতে এআই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু উত্তরের ভিডিওগুলো এআই দিয়ে তৈরি করা হয় না। এ আই ব্যবহার করে উত্তরের জন্য সঠিক ক্লিপটি অনুসন্ধান করা হয় শুধু।
জাদুঘরের কর্মকর্তারা 'ভয়েস ফ্রম দ্য ফ্রন্ট' প্রদর্শনী চালু করার পর থেকেই সেটি দর্শনার্থীদের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলেছে। অল্প বয়সী দর্শনার্থীরা যারা ইতোমধ্যেই দীর্ঘ সময় অন-স্ক্রিন কথোপকথন করতে অভ্যস্ত তারা নতুন এ প্রদর্শনীর সাথে সহজে মানিয়ে নিয়েছেন।
নিউ অরলিন্সের ২৪ বছর বয়সী দর্শনার্থী ডেভিন ডুমাস মেডেল অব অনার পাওয়া 'উডি' উইলিয়ামসের সাথে দীর্ঘ কথোপকথনে মেতে উঠেছিলেন। যদিও উইলিয়ামস ডুমাসের জন্মের ৭৭ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ২০২২ সালে মারা গিয়েছেন, দেখে মনে হচ্ছিল দুজন ব্যক্তি স্বাভাবিক কথোপকথন করছেন।
ডুমাসের কাছে অভিজ্ঞতাটি থেকে মনে হয়েছে তিনি যেন উডির বাসায় বসে তার সাথে কথা বলছেন।
প্রদর্শনীটি স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যের গল্পের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সাথে আরো ভালোভাবে যুক্ত হওয়া সম্ভব। পাশাপাশি এটি স্মরণ করিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া যেসব ব্যক্তি এখনো বেঁচে আছেন তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অথবা ভয়ানক স্মৃতি কেবলই দ্রুত হারিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সেই সেরা প্রজন্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়