ইসরায়েলে হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কবার্তা দিয়েছিল ইরান!
তুরস্ক, জর্ডান ও ইরাকি কর্মকর্তারা রোববার বলেছেন, ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েকদিন আগে থেকে ইরান সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিল, কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন তেহরান ওয়াশিংটনকে সতর্ক না করেই ইচ্ছাপূর্বক আক্রমণ চালিয়েছে।
গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শনিবার শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।
যদিও ইরানের ছোঁড়া প্রায় চার শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তারা বলছে, ইসরায়েল ও অন্য কয়েকটি দেশ মিলে কিছু ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের গতিরোধ করেছে, যার বেশিরভাগ হয়েছে ইসরায়েলের আকাশসীমার বাইরে।
আইডিএফের (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি জানান, কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাত করেছে এবং একটি সামরিক ঘাঁটির সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তবে এতে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরআবদুল্লাহিয়ান রোববার বলেছেন, ইরান, ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে হামলা চালানোর ৭২ ঘণ্টার আগে নোটিশ দিয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলার আগে তারা ওয়াশিংটন ও তেহরান উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল। তুর্কির কূটনৈতিক সূত্র অনুসারে, ইরান আশ্বস্ত করেছিল যে তারা শুধু দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার জবাব দেবে, এর বেশি কিছু করবে না। আর ইরান যে হামলা চালাবে তা তুরস্ক জানত। ফলে হামলার পর খুব বেশি অবাক হয় নি তারা।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমির আবদুল্লাহিয়ানের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুইস মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ থাকলেও হামলার ৭২ ঘণ্টার আগাম নোটিশ তারা পায়নি বলে তারা নিশ্চিত করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এটা একেবারেই সত্যি নয়। ইরান কোনও আগাম সতর্কবার্তা দেয়নি। তারা জানায়নি এই স্থানগুলোতে হামলা হবে, তাই সেখান থেকে বেসামরিক লোকজন সরিয়ে নাও।'
ওই মার্কিন কর্মকর্তা আরও জানান, হামলা শুরুর পরই তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, যাতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। তিনি বলেন, 'সুইসদের মাধ্যমে আমরা ইরানিদের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছি। বার্তায় তারা দাবি করে যে আক্রমণটি সমাপ্ত হয়েছে, যদিও এটি তখনও চলছিল।'
ইরাকি, তুর্কি ও জর্ডানের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, ইরান গত সপ্তাহে হামলার বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল। ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বয়ে এই হামলাটি হতাহতের কারণ এবং সংঘাত বাড়ানোর উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করেছিল। শুক্র ও শনিবার মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা আসন্ন হামলার আশঙ্কা করছেন এবং এর বিরুদ্ধে ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তেহরানের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সংক্ষিপ্ত বার্তা ছিল, 'করবেন না'।
সরকারের এক নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও এক নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ ইরাকের দুটি সূত্র জানিয়েছে, হামলার অন্তত তিন দিন আগে বাগদাদকে অবহিত করেছিল ইরান। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরাকি সুরক্ষা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হামলার সময় জানিয়ে দেয়া হয়, যার ফলে বাগদাদ তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়াতে পেরেছিল।
জর্ডানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রকাশ করেছেন যে ইরান তেহরানে আরব রাষ্ট্রদূতদের তলব করে তাদের আক্রমণ চালানোর অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত করেছে, যদিও সময় নির্দিষ্ট করে জানায়নি। ইরান লক্ষ্যবস্তু এবং অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে কিনা জানতে চাইলে জর্ডানের সূত্রটি সরাসরি উত্তর না দিলেও ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদে বাদানুবাদ
ইরান বলেছে, শনিবারের হামলা জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিরাপত্তা পরিষদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা হলে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত আত্মরক্ষার অনুমতির কথা বলা আছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের কোনও পরিকল্পনা ইরানের নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরান, তার নাগরিক বা নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে, তাহলে ইরান সে অনুযায়ী যেকোনো জবাব দিতে প্রস্তুত থাকবে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট উড হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'ইরান বা তার মিত্ররা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয় তাহলে এর জন্য ইরান দায়ী থাকবে।'
এই কূটনীতিক জোর দিয়ে বলেন, 'নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই ইরানের কর্মকাণ্ডের জবাব চাইতে হবে। ইরান তার আইআরজিসি'র কর্মকাণ্ড, হিজবুল্লাহকে সমর্থন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুথিদের হামলায় সহায়তা এবং লোহিত সাগরে বণিক ও বাণিজ্যিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছে'। উড আরও অভিযোগ করেছেন, ইরান ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলায় জড়িত ছিল এবং হামাসকে যথেষ্ট অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল।
তিনি বলেন, জাতিসংঘে ইরানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্র আরও পদক্ষেপ খতিয়ে দেখবে। তিনি ইরানের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাতে এবং ইরান, তার মিত্র ও প্রক্সিদের হামলা বন্ধের দাবি জানাতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাড আরদান বলেন, গোটা বিশ্বকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ার আগে ইরানকে থামাতেই হবে। এ আঞ্চলিক যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরদান আরও অভিযোগ করেন, ইরান শুধু বিশ্বে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়—'ইসলাম বা মুসলিমদের জন্য কোনও মাথাব্যথা নেই' তেহরানের। এরপর তিনি জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের ওপর ইসরায়েলের ইরানি ড্রোন প্রতিহত করার একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান।
জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি বারবারা উডওয়ার্ড ইসরায়েলে ইরানের হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, তেহরান এ অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়।
রাশিয়ার প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া নিরাপত্তা পরিষদকে ভণ্ডামি এবং দ্বৈত নীতি প্রয়োগের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার পর বা সিরিয়া ও লেবাননে ইসরায়েলের বারবার হামলার পর পরিষদ অধিবেশন বসায়নি। রুশ দূত সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদ যদি এ ধরনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান অর্থহীন বা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
চীনের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি দাই বিং বলেন, ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে ইরান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বিষয়টি সমাপ্ত হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।
দাই আরও বলেন, 'যদি গাজা সংঘাত চলতে থাকে, তাহলে এই বিরূপ উপস্থিতি আরও ছড়িয়ে পড়বে, যা এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও জনগণের কোনও বড় যুদ্ধে জড়ানোর ইচ্ছা ও সামর্থ্য কোনটিই নেই।'
আলজেরিয়ার উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি নাসিম গাউয়াউই বলেছেন ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের কারণে গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসনকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি এটিকে রাফায় স্থল আক্রমণের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। আলজেরিয়া গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বন্ধের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন